Qurban Mein Unko Bakhshish Mein

উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা মতভিন্নতার মাঝেও সম্প্রীতি রক্ষা



 গবেষণামূলক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর মুখপত্র
মাসিক আলকাউসার
জুন-২০১২, রজব-১৪৩৩
وحدة الأمة واتباع السنة উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা মতভিন্নতার মাঝেও সম্প্রীতি রক্ষা, সুন্নাহসম্মত পন্থায় সুন্নাহর প্রতি আহবান
মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক   http://www.alkawsar.com/article/590 http://www.alkawsar.com/article/611  http://www.alkawsar.com/article/632
গত ২৩ রবিউস সানী ১৪৩৩ হিজরীমোতাবেক ১৭ মার্চ ২০১২ শনিবার কাকরাইল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার উদ্যোগে ‘উম্মাহর ঐক্য : পথ  পন্থা’ শিরোনামে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সেমিনারে আলকাউসারের তত্ত্বাবধায়কের পক্ষ থেকে যে প্রবন্ধটি উপস্থাপিত হয়েছিল তা হুবহু বা তার সারসংক্ষেপ আলকাউসারে প্রকাশের জন্য অনেক বন্ধু/পাঠক জোর আবেদন জানিয়েছেন। সেমিনারে উপস্থিত বন্ধুরা প্রবন্ধটি পুস্তক আকারে পেলেও আলকাউসারের অধিকাংশ পাঠকের কাছে তা পৌঁছেনি। এজন্য সামান্য পরিবর্তন-পরিমার্জনের পর প্রবন্ধটির সারসংক্ষেপ আলকাউসারে প্রকাশ করা হচ্ছে। এটি প্রবন্ধের চতুর্থ কিস্তি। যাদের কাছে মূল প্রবন্ধটি রয়েছে তাদের জন্যও তা  উপকারী হবে বলে আশা রাখি।
বর্তমান সংখ্যা  আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত আলোচনা মূলত উক্ত প্রবন্ধের পরিবর্ধিত  সম্পাদিত দ্বিতীয় সংস্করণযা গত  রজব, ’৩৩ হি.,মোতাবেক ২৬ মে ’১২ একই স্থানে অনুষ্ঠিত সেমিনারের (দ্বিতীয় পর্বউপলক্ষে প্রস্ত্তত করা হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা এটিকে উপকারী করুন। আমীন।-সম্পাদক 

মুসলিম উম্মাহ পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং নিজেদের একতা ও সংহতি রক্ষা করা ইসলামের একটি মৌলিক ফরয। তেমনিসুন্নাহর অনুসরণ তথা  আল্লাহর রাসূলের শরীয়ত এবং তাঁর উসওয়াহ ও আদর্শকে সমর্পিত চিত্তে স্বীকার করা এবং বাস্তবজীবনেচর্চা করা তাওহীদ ও ঈমান বিল্লাহর পর ইসলামের সবচেয়ে বড় ফরয।  
সুতরাং সুন্নাহর অনুসরণ যে দ্বীনের বিধান উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষা এবং বিভেদ ও অনৈক্য থেকে বেঁচে থাকাও সেইদ্বীনেরই বিধান। এ কারণে এ দুইয়ের মাঝে বিরোধ ও সংঘাত হতেই পারে না। সুতরাং একটির কারণে অপরটি ত্যাগ করারওপ্রশ্ন আসে না। কিন্তু এখন আমরা এই দুঃখজনক বাস্তবতার সম্মুখীন যে, হাদীস অনুসরণ নিয়ে উম্মাহর মাঝে বিবাদ-বিসংবাদসৃষ্টি করা হচ্ছে। উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির প্রশ্নে মুজতাহিদ ইমামগণকে এবং তাদের সংকলিত ফিকহী মাযহাবসমূহকে দায়ীকরা হচ্ছে। অথচ ফিকহের এই মাযহাবগুলো হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর বিধিবিধানেরই ব্যাখ্যা এবং তার সুবিন্যস্ত ও সংকলিত রূপ।মূলে তা ফকীহ ও মুজতাহিদ সাহাবীগণের মাযহাব, যা উম্মাহর অবিচ্ছিন্ন কর্মপরম্পরা তথা তাওয়ারুছের মাধ্যমে চলে এসেছে। 
এই অবস্থা প্রমাণ করে, আমাদের অনেকে সুন্নাহ অনুসরণের মর্ম ও তার সুন্নাহসম্মত পন্থা এবং সুন্নাহর প্রতি আহবানেরসুন্নাহসম্মত উপায় সম্পর্কে দুঃখজনকভাবে উদাসীন। তদ্রূপ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির সঠিক উপলব্ধি এবংঐক্যবিনাশী বিষয়গুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তির শিকার।
সুন্নাহর অনুসরণ এবং উম্মাহর ঐক্য দুটো বিষয়ই অনেক দীর্ঘ এবং উভয় ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে চলমান অবহেলা ও ভুলধারণা ব্যাপক। সবকটি দিক নিয়ে এ প্রবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব নয়। এখানে শুধু প্রবন্ধের শিরোনাম (মতভিন্নতার মাঝেওসম্প্রীতি রক্ষা; সুন্নাহসম্মত পন্থায় সুন্নাহর প্রতি আহবান)-এর সাথে সম্পৃক্ত কিছু মৌলিক বিষয় আলোচনা করা উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক কথা বলার এবং ইখলাস ও ইতকানের সাথে উপস্থাপন করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
ঐক্য  সংহতি এবং সৌহার্দ্য  সম্প্রীতির গুরুত্ব
ইসলাম তাওহীদের দ্বীন এবং ঐক্যের ধর্ম। এখানে শিরকের সুযোগ নেই এবং অনৈক্য ও বিভেদের অবকাশ নেই। ইসলামেঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ-এক আল্লাহর ইবাদত, এক আল্লাহর ভয়।
এই তাওহীদের সমাজকে ইসলাম আদেশ করে সীরাতে মুস্তাকীম ও সাবীলুল মুমিনীনের উপর একতাবদ্ধ থাকার, নিজেদেরঐক্য ও সংহতি এবং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি রক্ষা করার, ইজমা ও সাবীলুল মুমিনীনের বিরোধিতা পরিহার করার এবং এমন সবকর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার, যা উম্মাহর একতা নষ্ট করে এবং সম্প্রীতি বিনষ্ট করে।
সাবীলুল মুমিনীন থেকে বিচ্যুত হওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে কুফর এবং পরস্পর কলহ-বিবাদে লিপ্ত হওয়া হারাম ও কবিরা গুনাহ।
কথাগুলো যদিও দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট এবং উম্মাহর সর্ববাদীসম্মত আকীদা তবুও পুনস্মরণের স্বার্থে কিছু আয়াত ও হাদীসউল্লেখ করা হচ্ছে।
(এ প্রসঙ্গে মূল প্রবন্ধে আটটি সূরার সর্বমোট ২৭টি আয়াত রয়েছে। এখানে আরবী পাঠ ও তরজমাসহ কয়েকটি আয়াত উল্লেখকরা হল।
إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ ۞ وَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ كُلٌّ إِلَيْنَا رَاجِعُونَ ۞
(তরজমা) ‘নিশ্চিত জেনো, এই তোমাদের উম্মাহ, এক উম্মাহ (তাওহীদের উম্মাহ) এবং আমি তোমাদের রব। সুতরাং আমারইবাদত কর। কিন্তু তারা নিজেদের দ্বীনকে নিজেদের মাঝে টুকরা টুকরা করে ফেলেছে। (তবে) সকলেই আমার কাছে ফিরেআসবে।-সূরাতুল আম্বিয়া (২১) : ৯২-৯৩
وَإِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاتَّقُونِ ۞ فَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ زُبُرًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ ۞ فَذَرْهُمْ فِي غَمْرَتِهِمْ حَتَّى حِينٍ ۞
(তরজমা) ‘নিশ্চিত জেনো, এই তোমাদের উম্মাহ, এক উম্মাহ (তাওহীদের উম্মাহ) এবং আমি তোমাদের রব। সুতরাং আমাকেভয় কর। এরপর তারা নিজেদের দ্বীনের মাঝে বিভেদ করে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেল। প্রত্যেক দল (নিজেদের খেয়ালখুশিমতো) যে পথ গ্রহণ করল তাতেই মত্ত রইল। সুতরাং (হে পয়গাম্বর!) তাদেরকে এক নির্ধারিত সময় পর্যন্ত মূর্খতায় ডুবে থাকতেদাও।-সূরা মুমিনুন (২৩) : ৫২-৫৩
উপরের দোনো জায়গায় নবীগণ যে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন তা বর্ণনা করার পর বলা হয়েছে, আল্লাহর কাছে উম্মতএকটিই। আর তা হচ্ছে তাওহীদের উম্মত। সূরা ইউনুস (১০ : ১৯) ও সূরা বাকারায় (২ : ২১৩) বলা হয়েছে যে, আদিতে সকলমানুষ এ সমাজেই ছিল। পরে লোকেরা কুফর ও শিরক অবলম্বন করে আলাদা উম্মত, আলাদা সমাজ বানিয়ে নিয়েছে।
তাই উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে তাওহীদ। تَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُم (তারা নিজেদের দ্বীনকে নিজেদের মাঝে টুকরা টুকরা করেফেলেছে) বাক্যে আকীদায়ে তাওহীদ এবং দ্বীনের অন্যান্য মৌলিক ও অকাট্য আকীদা ও বিধানসমূহ (জরুরিয়াতে দ্বীনের)অস্বীকার বা অপব্যাখ্যার মাধ্যমে আলাদা মিল্লাত ও আলাদা উম্মত সৃষ্টির নিন্দা করা হয়েছে।
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيبُ ۞ وَمَا تَفَرَّقُوا إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ وَلَوْلَا كَلِمَةٌ سَبَقَتْ مِنْ رَبِّكَ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ أُورِثُوا الْكِتَابَ مِنْ بَعْدِهِمْ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مُرِيبٍ ۞فَلِذَلِكَ فَادْعُ وَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَقُلْ آَمَنْتُ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنْ كِتَابٍ وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ اللَّهُ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ لَا حُجَّةَ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ اللَّهُ يَجْمَعُ بَيْنَنَا وَإِلَيْهِ الْمَصِيرُ ۞

(তরজমা) তিনি তোমাদের জন্য সেই দ্বীনই স্থির করেছেন, যার হুকুম দিয়েছিলেন নূহকে এবং (হে রাসূল!) যা আমি ওহীরমাধ্যমে তোমার কাছে পাঠিয়েছি এবং যার হুকুম দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে; যে, কায়েম রাখ এই দ্বীন এবং তাতেসৃষ্টি করো না বিভেদ। (তা সত্ত্বেও) মুশরিকদের তুমি যে দিকে ডাকছ তা তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুভার মনে হয়। আল্লাহ তাআলাযাকে ইচ্ছা বাছাই করে নিজের দিকে আকৃষ্ট করেন এবং যে আল্লাহর দিকে রুজু হয় তাকে নিজ দরবার পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য দানকরেন।
এবং মানুষ যে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তা হয়েছে তাদের কাছে নিশ্চিত জ্ঞান আসার পরই, পারস্পরিক শত্রুতার কারণে। তোমারপ্রতিপালকের পক্ষ হতে যদি একটি কথা নির্ধারিত কাল পর্যন্ত পূর্বেই স্থির না থাকত তবে তাদের বিষয়ে ফয়সালা হয়ে যেত।তাদের পর যারা কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়েছে তারা এ সম্পর্কে এক বিভ্রান্তিকর সন্দেহে পড়ে আছে।
‘সুতরাং (হে রাসূল!) তুমি ঐ বিষয়ের দিকেই মানুষকে আহবান কর এবং অবিচল থাক, যেরূপ তোমাকে আদেশ করা হয়েছে।এবং তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না। বল, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন আমি তার প্রতি ঈমান এনেছি এবং আমিআদিষ্ট হয়েছি তোমাদের মাঝে ন্যায়বিচার করতে। আল্লাহ আমাদের রব এবং তোমাদেরও রব। আমাদের কর্ম আমাদের,তোমাদের কর্ম তোমাদের। আমাদের ও তোমাদের মাঝে কোনো তর্ক নেই। আল্লাহ আমাদের সকলকে একত্র করবেন এবং তাঁরইকাছে সকলের প্রত্যাবর্তন।-সূরাতুশ শূরা (৪২) : ১৩-১৫
দ্বীনের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির অর্থ, তাওহীদ বা অন্য কোনো মৌলিক বিষয় সরাসরি অস্বীকার করে কিংবা তাতে অপব্যাখ্যা করেতাওহীদের উম্মাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া।
হক সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান আসার পর এ বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা কেবল জিদ ও হঠকারিতার কারণেই হয়ে থাকে। শাখাগত বিষয়েকুরআন-সুন্নাহর দলিলভিত্তিক যে মতপার্থক্য তা এখানে উদ্দেশ্য হতে পারে না। কারণ অনেক শাখাগত বিধানের ক্ষেত্রে স্বয়ংনবীগণের শরীয়তেও বিভিন্নতা ছিল। অথচ তাঁদের সবার দ্বীন ছিল এক। তাঁরা সবাই ছিলেন তাওহীদপন্থী এবং অভিন্ন।
অন্য অনেক আয়াতের মতো উপরের আয়াতগুলোতেও স্পষ্ট নির্দেশনা আছে যে, দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে মতভেদ হতে পারে না।এখানে মতভেদ অর্থই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা।
আর এই বিভেদের দায় ঐ মতভেদকারীকেই বহন করতে হবে। যারা হকপন্থী, তাদেরকে নয়। কারণ ঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদও মৌলিক আকিদা ও বিধান। যারা এর উপর আছে তারা তো মূল পথেই রয়েছে। যারা মতভেদ করেছে তারা এই পথ থেকে সরেগেছে এবং বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছে। আর এ কথা বলাই বাহুল্য যে, তাওহীদের বিষয়ে বা দ্বীনের অন্য কোনো মৌলিকবিষয়ে হক থেকে বিচ্যুত হওয়া বা সন্দেহ-সংশয় পোষণ করা খেয়ালখুশির অনুগামিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এখানে ইসলামের অতুলনীয় ও ন্যায়সঙ্গত শিক্ষাটিও লক্ষণীয় যে, যারা মৌলিক বিষয়ে মতভেদ করে বিচ্ছিন্ন হল তাদের সাথেওজুলুম-অবিচার করা যাবে না; তাদের সাথেও ন্যায়বিচার করতে হবে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ ۞ وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آَيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ ۞ وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ۞وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ ۞ يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ ۞ وَأَمَّا الَّذِينَ ابْيَضَّتْ وُجُوهُهُمْ فَفِي رَحْمَةِ اللَّهِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ۞

 (তরজমা) ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে সেভাবে ভয় কর যেভাবে তাকে ভয় করা উচিৎ। এবং (সাবধান) তোমাদের মৃত্যুযেন এ অবস্থায়ই আসে যে, তোমরা মুসলিম।
তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভেদ করো না। স্মরণ কর যখন তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলেতখন আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। তিনি তোমাদের অন্তরসমূহ একে অপরের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন। ফলে তাঁরঅনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছ। তোমরা তো ছিলে অগ্নিকুন্ডের প্রান্তে। আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের মুক্ত করেছেন।এভাবেই আল্লাহ তাঁর বিধানসমূহ  সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যেন তোমরা পথপ্রাপ্ত হও।
‘তোমাদের মধ্যে যেন এমন একটি দল থাকে, যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে, সৎকাজের আদেশ করবে  এবং মন্দ কাজেবাধা দিবে। আর এরাই তো সফলকাম।
‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা বিচ্ছিন্ন হয়েছিল এবং মতভেদ করেছিল তাদের নিকট সুস্পষ্ট বিধানসমূহ পৌঁছার পর।এদের জন্যই রয়েছে ভীষণ শাসিত্ম।
‘যেদিন কতক মুখ উজ্জ্বল হবে আর কতক মুখ কালো হয়ে যাবে। যাদের মুখ কালো হবে তাদেরকে বলা হবে, তোমরা কুফরিকরলে ঈমান আনার পর?! সুতরাং স্বীয় কুফরির দরুণ শাস্তির স্বাদ গ্রহণ কর।
‘পক্ষান্তরে যাদের মুখ উজ্জ্বল হবে তারা আল্লাহর রহমতের মধ্যে থাকবে। সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে।’-সূরা আলে-ইমরান(৩) : ১০২-১০৭
‘হাবলুল্লাহ’-আল্লাহর রজ্জু অর্থ আলকুরআন এবং আল্লাহর সাথে কৃত বান্দার সকল অঙ্গিকার, যার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণঅঙ্গিকারটি এই যে, আমরা শুধু রবেরই ইবাদত করব, অন্য কারো নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, এই তাওহীদ ও কুরআনকেদৃঢ়ভাবে ধারণ কর। তাওহীদ ত্যাগ করে কিংবা কুরআনের কোনো বিধান থেকে বিমুখ হয়ে বিভেদ করো না। তো এখানেও ঐকথা-ঐক্যের ভিত্তি তাওহীদ ও কুরআন।
আরো বোঝা গেল যে, তাওহীদপন্থী উম্মাহর পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেয়ামত। আর এনেয়ামত হাসিল হবে সর্বপ্রকার ‘আসাবিয়াত’ থেকে মুক্ত হয়ে শুধু এবং শুধু ইসলামের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ এবং ইসলামীবিধিবিধানের আনুগত্যের দ্বারা। আউস ও খাযরাজের দৃষ্টান্ত  স্মরণ করুন, এই নেয়ামতে তাঁরা এতই সৌভাগ্যশালী হয়েছিলেনযে, তাঁদের গোত্রীয় পরিচয় ছাপিয়ে গেল এবং দ্বীনী পরিচয়ে-‘আনসার’ নামেই তাঁরা প্রসিদ্ধ হয়ে গেলেন।
‘বাইয়িনাত’ অর্থ কিতাব-সুন্নাহর অকাট্য ও সুস্পষ্ট দলিল, যা থেকে বিমুখ হয়ে মতভেদ করার অর্থই হল এ বিষয়েবিভেদ-বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করা, যা সম্পূর্ণ গর্হিত ও বর্জনীয়। যেমন ঈমানদার ও তাওহীদপন্থীদের সাথে কাফির-মুশরিকদেরমতভেদ। কট্টর বিদআতীদের মতভেদও অনেক সময় এই সীমানায় প্রবেশ করে। এই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শাস্তি আখেরাতে মুখকালো হওয়া।
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. এ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন-
تبيض وجوه أهل السنة والجماعة، وتسود وجوه أهل البدعة والفرقة
অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর মুখ উজ্জ্বল হবে এবং আহলুল বিদআহ ওয়াল ফুরকার মুখ কালোহবে।-তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/৫৮৪
এ থেকে বোঝা যায়, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অনুসারীগণ ‘আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করার এবং বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন নাহওয়ার’ আদেশ পালন করছেন, যার পুরস্কার তারা দুনিয়াতে পেয়ে থাকেন পরস্পর সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মাধ্যমে। আরআখিরাতের পুরস্কার এই হবে যে, তাদের চেহারা উজ্জ্বল হবে। পক্ষান্তরে যারা কালিমা পাঠ করেও সুন্নাহ ছেড়ে বিদআ অবলম্বনকরবে কিংবা উম্মাহর ঐক্যে আঘাত করে ‘আলজামাআ’ এর নীতি থেকে বিচ্যুত হবে তাদেরও আশঙ্কা আছে আয়াতের কঠিনহুঁশিয়ারির মাঝে পড়ে যাওয়ার।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামদের মাঝে শাখাগত বিষয়ে দলিলের ভিত্তিতে যে মতপার্থক্য, তা যেমন বিভেদ-বিচ্ছিন্নতানয় তেমনি এ আয়াতের হুঁশিয়ারিরও আওতাভুক্ত নয়। কারণ এ জাতীয় মতপার্থক্যের পরও তাঁরা একতাবদ্ধ ছিলেন এবং তাঁদেরমতপার্থক্য-আল্লাহর পানাহ-স্পষ্ট বিধান থেকে বিমুখতার কারণেও ছিল না। তা তো ছিল ‘বাইয়্যিনাত’-এর উপর ইজমা ওইত্তিহাদের পর কিছু শাখাগত বিষয়ে দলিলভিত্তিক ইখতিলাফ। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসছে ইনশাআল্লাহ।
وَلَقَدْ آتَيْنَا بَنِي إِسْرَائِيلَ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ ۞ وَآتَيْنَاهُمْ بَيِّنَاتٍ مِنَ الْأَمْرِ فَمَا اخْتَلَفُوا إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ إِنَّ رَبَّكَ يَقْضِي بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ ۞ ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَى شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ۞ إِنَّهُمْ لَنْ يُغْنُوا عَنْكَ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَإِنَّ الظَّالِمِينَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُتَّقِينَ ۞ هَذَا بَصَائِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ۞
(তরজমা) ‘আমি তো বনী ইসরাইলকে কিতাব, রাজত্ব ও নবুওয়ত দান করেছিলাম। তাদেরকে উত্তম রিযিক প্রদান করেছিলামএবং জগদ্বাসীর উপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম।
‘আমি তাদেরকে দ্বীনের সুস্পষ্ট বিধানাবলি দান করেছিলাম। অতপর তারা যে মতভেদ করল তা তাদের কাছে ইলম আসার পরইকরেছিল শুধু পরস্পর বিদ্বেষবশত। তারা যে বিষয়ে মতভেদ করত তোমার প্রতিপালক কিয়ামতের দিন সে বিষয়ে তাদের মাঝেফয়সালা করে দিবেন।
‘এরপর আমি তোমাকে দ্বীনের এক বিশেষ শরীয়তের উপর রেখেছি। সুতরাং তা অনুসরণ কর, অজ্ঞদের খেয়ালখুশির অনুসরণকরো না।
‘আল্লাহর মুকাবিলায় তারা তোমার কিছুমাত্রও কাজে আসবে না। বস্ত্তত জালিমরা একে অপরের বন্ধু। আর আল্লাহ বন্ধুমুত্তাকীদের।
‘এটি (কুরআন) সকল মানুষের জন্য প্রকৃত জ্ঞানের সমষ্টি এবং দৃঢ়বিশ্বাসীদের জন্য গন্তব্যে পৌঁছার মাধ্যম ও রহমত।’-সূরাজাছিয়া (৪৫) : ১৬-২০
‘বাইয়িনাত’ তথা অকাট্য ও সুস্পষ্ট দলিল দ্বারা হকের নিশ্চিত জ্ঞান অর্জিত হয়। যে তা থেকে বিমুখ হয়ে মতভেদ করে তারমতভেদের ভিত্তি হঠধর্মিতা ও সীমালঙ্ঘন। এই মতভেদ হচ্ছে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা।
 এ আয়াতে এ কথাও দ্ব্যর্থহীনভাবে আছে যে, তাওহীদের সাথে শরীয়তের আনুগত্যও অপরিহার্য। শরীয়তকে মেনে নেওয়াপ্রকৃতপক্ষে ‘তাওহীদ ফিততাশরী’ তথা বিধানদাতা একমাত্র আল্লাহ-এ বিশ্বাসেরই বহিঃপ্রকাশ। সূরা মায়েদা (৫) : ৪৮ এবং অন্যঅনেক জায়গায় সাবধান করা হয়েছে যে, ‘শরয়ে মুনাযযাল তথা আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিলকৃত সুস্পষ্ট বিধানাবলির কোনোএকটি বিধানের বিরোধিতাও হারাম ও কুফর।
বস্ত্তত জালিমরা একে অপরের বন্ধু আর আল্লাহ বন্ধু মুত্তাকীদের-এ বাক্যে ولاء  ও براء বা موالاة  ও معاداة তথা বন্ধুতা ও শত্রুতার নীতিবলা হয়েছে। ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি এই যে, ‘মুয়ালাত’ বা বন্ধুত্বের মানদন্ড হচ্ছে ঈমান ও ইসলাম। আর‘মুআদাত’ বা শত্রুতার মানদন্ড হচ্ছে শিরক ও কুফর। যে কেউ শরীয়তের দৃষ্টিতে মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত সে কেবল তারঈমান ও ইসলামের কারণেই, অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য ছাড়াই, মুয়ালাত ও বন্ধুত্বের এবং সকল ইসলামী অধিকার পাওয়ার হকরাখে। আর যে এই মানদন্ডে উত্তীর্ণ নয়, অর্থাৎ যে শিরক বা কুফরে লিপ্ত (প্রত্যেক কুফর শিরকেরই বিভিন্ন প্রকার) তার সাথে‘মুয়ালাত’ বা বন্ধুত্ব হারাম; বরং তা কুফরের আলামত।
(এরপর এ বিষয়ে চারটি সূরা : সূরায়ে তাওবা (৯) : ৩, ২৩-২৪, ৭১; সূরা লুকমান (৩১) : ১৪-১৫; সূরা মুমতাহিনা (৬০) : ১, ৪;সূরা মুজাদালা (৫৮) : ১৪-২২ আয়াতের তরজমা উদ্ধৃত করা হয়েছে। সূরায়ে মুজাদালার (৫৮) : ১৪-২২ আয়াতগুলো উদ্ধৃত করারপর প্রবন্ধকার বলেন-)
দল মূলত দুটি :
১. হিযবুল্লাহ বা আল্লাহর দল
২. হিযবুশ শয়তান বা শয়তানের দল।
যার অন্তরে ঈমান আছে এবং মুমিনদের সাথে মুয়ালাত ও হৃদ্যতা পোষণ করে আর কাফির-মুশরিকদের থেকে বারাআত ওসম্পর্কহীনতা প্রকাশ করে সে হিযবুল্লাহর অন্তর্ভুক্ত। তাকে হিযুবল্লাহ থেকে খারিজ করা কিংবা হিযবুশ শয়তানের দিকে নিসবতকরা সম্পূর্ণ হারাম। হিযবুল্লাহর মাপকাঠি হচ্ছে ঈমান, মুমিনদের প্রতি মুয়ালাত ও হৃদ্যতা এবং আহলে কুফর ও শিরকের সাথেমুআদাত ও শত্রুতা।
মুয়ালাত ও বারাআতের এই ইসলামী নীতি থেকে পরিষ্কার হয় যে, ঐক্যের অর্থ ঈমান ও ইসলামের সূত্রে একতাবদ্ধ থাকা।ঐক্যের ভিত্তি হবে তাওহীদ। তাওহীদ ত্যাগ করে এবং দ্বীনের মূলনীতি বিসর্জন দিয়ে কোনোরূপ ঐক্য গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ তাকরলে সে আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং তাওহীদ ও ইত্তিহাদ দুটোই তার হাতছাড়া হয়।
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ وَاصْبِرُوا إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। পরস্পর বিবাদ করো না তাহলে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব বিলুপ্ত হবে।আর ধৈর্য্য ধারণ কর। নিশ্চিত জেনো, আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে আছেন।-সূরা আনফাল (৮) : ৪৬
এ আয়াতে ‘তাওহীদ ফিততাশরী’ তথা একমাত্র আল্লাহকেই বিধানদাতা বলে বিশ্বাস করার আদেশ আছে। শর্তহীন আনুগত্যএকমাত্র আল্লাহর এবং আল্লাহর আদেশে তাঁর রাসূলের। অন্য সকলের আনুগত্য এ আনুগত্যের অধীন। সাথে সাথে কলহবিবাদথেকে বিরত থাকার আদেশ করা হয়েছে এবং এর বড় দুটি কুফল সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে : এক. এর দ্বারা উম্মাহ শক্তিহীনহয়ে পড়বে, দুই. তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি লোপ পাবে।
বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, রাসূলের আনুগত্য তথা সুন্নাহর অনুসরণের আদেশের সাথে ঐক্য ও সংহতি রক্ষা এবং কলহবিবাদথেকে আত্মরক্ষার তাকীদ করা হয়েছে।
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ۞ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُونُوا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِنْ نِسَاءٍ عَسَى أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوا أَنْفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَالِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ۞ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ ۞ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ ۞
(তরজমা) ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মাঝে  মীমাংসা করে দাও। আল্লাহকে ভয় কর,যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও।
‘হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে। সে (অর্থাৎ যাকে উপহাস করা হচ্ছে) তার চেয়ে উত্তম হতেপারে। এবং কোনো নারীও যেন অপর নারীকে উপহাস না করে। সে (অর্থাৎ যে নারীকে উপহাস করা হচ্ছে) তার চেয়ে উত্তম হতেপারে। তোমরা একে অন্যকে দোষারোপ করো না এবং একে অন্যকে মন্দ উপাধিতে ডেকো না। ঈমানের পর ফিসকের নাম যুক্তহওয়া কত মন্দ! যারা এসব থেকে বিরত হবে না তারাই জালেম।
‘হে মুমিনগণ! অনেক রকম অনুমান থেকে বেঁচে থাক। কোনো কোনো অনুমান গুনাহ। তোমরা কারো গোপন ত্রুটি অনুসন্ধানকরবে না এবং একে অন্যের গীবত করবে না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? এটা তোতোমরা ঘৃণা করে থাক। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই তিনি বড় তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে এবং তোমাদের মাঝে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রবানিয়েছি। যাতে একে অন্যকে চিনতে পার। নিশ্চিত জেনো, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান, যেতোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন।’-সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১০-১৩
এই আয়াতগুলোতে মুমিনদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের চেতনা জাগ্রত করা হয়েছে এবং মুমিনের কাছে মুমিনের প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কেবলা হয়েছে। এই আয়াতগুলো থেকে প্রমাণ হয়, ভ্রাতৃত্বের মানদন্ড শুধু ঈমান। সুতরাং উল্লেখিত অধিকারগুলো মুমিনমাত্রেরইপ্রাপ্য তার মুমিন ভাইয়ের কাছে।
ঈমানী ভ্রাতৃত্বের রয়েছে অনেক দাবি। এ আয়াতে বিশেষভাবে এমন কিছু দাবি উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো পূরণ না করারকারণে সমাজে কলহ-বিবাদ সৃষ্টি হয়। তেমনি কলহ-বিবাদ সৃষ্টি হলে এই বিষয়গুলো আরো বেশি লঙ্ঘিত হয়। অভিজ্ঞতায় দেখাযায়, দ্বীনী-দুনিয়াবী মতভেদের ক্ষেত্রে একে অপরকে উপহাস ও তাচ্ছিল্য করা, গীবত করা, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া, কুধারণাপোষণ করা, কটুক্তি করা, খারাপ নামে বা মন্দ উপাধিতে ডাকা-এই সব বিষয়ের চর্চা হতে থাকে। লোকেরা যেন ভুলেই যায় যে,কুরআন মজীদে এ বিষয়গুলোকে হারাম করা হয়েছে। প্রত্যেকের আচরণ থেকে মনে হয়, প্রতিপক্ষের ইজ্জত-আব্রু নষ্ট করাহালাল! মতভেদের কারণে তার কোনো ঈমানী অধিকার অবশিষ্ট নেই। অথচ এ তো শুধু মুমিনের হক নয়, সাধারণ অবস্থায়মানুষমাত্রেরই হক। একজন মানুষ অপর একজন মানুষের কাছে এই নিরাপত্তাটুকু পাওয়ার অধিকার রাখে। এমনকি যদি সেমুসলিমও না হয়।
হায়! বিরোধ ও মতভেদের ক্ষেত্রে যদি আমরা প্রতিপক্ষকে অন্তত একজন মানুষ মনে করে তার গীবত-শেকায়েত থেকে, মিথ্যাঅপবাদ দেওয়া থেকে, উপহাস-বিদ্রূপ করা থেকে ও মন্দ নামে ডাকা থেকে বিরত থাকতাম! আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহয় তোজীবজন্তু, এমনকি জড় বস্ত্তরও হক ও অধিকার বর্ণিত হয়েছে। তো মতভেদকারী আর কিছু না হোক একজন প্রাণী তো বটে!!
লক্ষ্য করুন, আল্লাহ তাআলা কী বলেছেন-
بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ
অর্থাৎ এই সকল হক যে ব্যক্তি রক্ষা করে না সে সমাজ ও শরীয়ত উভয়ের দৃষ্টিতে ফাসিক উপাধির উপযুক্ত হয়ে যায়। একজনমুমিনের জন্য তা কত বড় লজ্জা ও দুর্ভাগ্যের বিষয়?
তো দ্বীনী মতভেদের ক্ষেত্রে যদি এইসব আচরণ করা হয় এবং এ কারণে দ্বীনের পক্ষ হতেই ঐ ‘খাদিমে দ্বীনে’র নামের সাথেফাসিক উপাধি যুক্ত হয় তাহলে তা দ্বীন ও শরীয়তের কেমন খেদমত তা খুব সহজেই অনুমেয়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরহেফাযত করুন।
শেষ আয়াতে সমগ্র মানবজাতির জন্য ন্যায় ও সাম্যের এই গুরুত্বপূর্ণ নীতি ঘোষণা করা হয়েছে যে, বংশীয়, গোত্রীয় বা আঞ্চলিকপরিচিতি মর্যাদা ও শরাফতের মাপকাঠি নয়। মর্যাদার মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া ও খোদাভীরুতা। সকল মানুষ এক পুরুষ ও একনারীর সন্তান। এরপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে আলাদা আলাদা কওম, গোত্র বা খান্দানের পরিচয় এজন্য দান করেননি যে,এরই ভিত্তিতে তারা একে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করবে; বরং এই বৈচিত্রের একমাত্র উদ্দেশ্য, তাদেরকে ছোট ছোটশ্রেণীতে ভাগ করা, যাতে অসংখ্য আদমসন্তানের মাঝে পারস্পরিক পরিচিতি সহজ হয়।
ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও অঞ্চল এসব ছিল আরব জাহিলিয়াতে একতা ও জাতীয়তার মানদন্ড। আধুনিক জাহিলিয়াতে এসবের সাথেআরো যোগ হয়েছে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন দর্শন ও মতবাদকেন্দ্রিক একতা ও জাতীয়তা। এভাবে অসংখ্যবিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়ে একতা শব্দটি একটি অসার শব্দে পরিণত হয়েছে।
প্রাচীন ও আধুনিক উভয় জাহিলিয়াতে মর্যাদা ও শরাফতের মাপকাঠি ধরা হয়েছে আপন আপন পসন্দের নিসবত ও সম্বন্ধকে।এর বিপরীতে ইসলামের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা-ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু তাওহীদ, উম্মাহর জাতীয়তা ইসলাম, আর মর্যাদা ও শরাফতেরমাপকাঠি তাকওয়া। এভাবে শ্রেষ্ঠত্বের সকল জাহেলী মাপকাঠিকে ইসলাম বাতিল সাব্যস্ত করেছে এবং সব ধরনের আসাবিয়ত,অহংকার ও সাম্প্রদায়িকতাকে হারাম ঘোষণা করেছে।
আয়াতের উপরোক্ত শিক্ষা থেকে এ নীতিও প্রমাণিত হয় যে, পরিচিতির জন্য বংশীয় ও গোত্রীয় সম্বন্ধ ছাড়া আরো যে সকলজায়েয সম্বন্ধ ব্যবহার করা হয় সেগুলোকেও মর্যাদার মাপকাঠি মনে করা কিংবা সেসবের ভিত্তিতে মুয়ালাত ও বারাআত তথাবন্ধুত্ব ও শত্রুতার আচরণ করা হারাম। মর্যাদার মাপকাঠি তাকওয়া। মুয়ালাত ও বন্ধুত্বের মানদন্ড ঈমান আর কারো থেকেবারাআত ও সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কহীনতা ও দায়মুক্ততার কারণ শুধু শিরক ও কুফরই হতে পারে।
এ সকল জায়েয সম্বন্ধের মাঝে জন্মস্থান বা আবাসস্থলের সম্বন্ধ, ফিকহী মাযহাবের সম্বন্ধ, সুলুক ও ইহসানের তরীকাসমূহেরসম্বন্ধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্বন্ধ সবই অন্তর্ভুক্ত। কেউ যদি তার শিক্ষাকেন্দ্রের হিসাবে নামের সাথে মাদানী, আযহারী, নদভী বাদেওবন্দ্বী/কাসেমী লেখে তাহলে তা  নাজায়েয নয়। তেমনি ফিকহী মাযহাবের হিসাবে মালেকী, হাম্বলী, হানাফী বা শাফেয়ীলিখলে, কিংবা বিশেষ মাসলাক ও মাশরাব হিসাবে সালাফী বা আছারী লিখলে অথবা সুলূক ও ইহসানের তরীকা হিসাবেকাদেরী বা নকশবন্দী লিখলে তা নাজায়েয নয়। কিন্তু এই সম্বন্ধগুলোকেই মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি মনে করা, এসবেরভিত্তিতে বিভক্ত হওয়া, এসবের প্রতি আসাবিয়াত ও অন্যায় পক্ষপাত লালন করা, নিজের সম্বন্ধের, প্রতিষ্ঠানের,মাযহাব-মাশরাবের এবং তরীকার কোনো বিষয় সুস্পষ্ট দলিল দ্বারা ভুল প্রমাণিত হলেও তার উপর জিদ করা এবং ঈমানীভ্রাতৃত্বের দাবি পূরণের ক্ষেত্রে এসকল সম্বন্ধকে মাপকাঠি ও মানদন্ড মনে করা সম্পূর্ণ হারাম ও ফাসেকী।
হকের মানদন্ড হচ্ছে শরীয়তের দলিল, যাতে সীরাত ও আছারে সাহাবাও অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর কাছে মর্যাদার মাপকাঠি তাকওয়া।ঈমানী ভ্রাতৃত্ব ও তার হকসমূহের মানদন্ড ঈমান। ঈমানের অতিরিক্ত অন্য কোনো নিসবত বা সম্বন্ধের উপর এই সব  হকেরকোনোটিকে মওকুফ মনে করা কিংবা মওকুফ রাখা ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী।
হাদীস
কুরআন মজীদের আয়াতের পর আলোচ্য বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কিছু হাদীস পেশ করছি। প্রথমে ঈমানীভ্রাতৃত্বের বিষয়ে কিছু হাদীস উল্লেখ করব। এরপর ঐক্যের অপরিহার্যতা এবং অনৈক্যের বর্জনীয়তা সম্পর্কে কিছু হাদীস উল্লেখকরব ইনশাআল্লাহ।
(ঈমানী ভ্রাতৃত্বের বিষয়ে মূলপ্রবন্ধে সর্বমোট দশটি হাদীস রয়েছে। তন্মধ্যে দুটি হাদীস উল্লেখ করা হল।)
عن أبي هريرة رضي الله تعالى عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إياكم والظن، فإن الظن أكذب الحديث، ولا تَحَسَّسُوا، ولا تَجَسَّسُوا، ولا تَنَافَسُوا، ولا تَحَاسَدُوا، ولا تَبَاغَضُوا، ولا تَقَاطَعُوا، وَلا تهجروا، ولا تَدَابروا، ولا تناجشوا، ولا يبع بعضكم على بيع بعض، وكونوا كما أمركم الله عباد الله إخوانا.
المسلم أخو المسلم، لا يظلمه ولا يخذله ولا يحقره، التقوى ههنا، ويشير إلى صدره، ثلاث مرات.
بحسب امرئ من الشر أن يحقر أخاه المسلم، إن الله لا ينظر إلى أجسادكم، ولكن ينظر إلى قلوبكم، وأشار بأصابعه إلى صدره.
كل المسلم على المسلم حرام دمه وماله وعرضه.
رواه البخاري ومسلم، والسياق مأخوذ من مجموع رواياتهما.
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কারণধারণা হচ্ছে নিকৃষ্টতম মিথ্যা। তোমরা আঁড়ি পেতো না, গোপন দোষ অন্বেষণ করো না, স্বার্থের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ো না,হিংসা করো না, বিদ্বেষ পোষণ করো না, সম্পর্কচ্ছেদ করো না, পরস্পর কথাবার্তা বন্ধ করো না, একে অপর থেকে মুখ ঘুরিয়েনিও না, দাম-দস্ত্তরে প্রতারণা করো না এবং নিজের ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের মাঝে ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা করো না। হে আল্লাহরবান্দারা! আল্লাহ যেমন আদেশ করেছেন, সবাই তোমরা আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও।’-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫১৪৩,৬০৬৪, ৬০৬৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৬৩/২৮, ২৯, ৩০ ও ২৫৬৪/৩২, ৩৩
عن أبي برزة الأسلمي قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : يا معشر من آمن بلسانه ولم يدخل الإيمان قلبه لا تغتابوا المسلمين ولا تتبعوا عوراتهم فإنه من يتبع عورة أخيه يتبع الله عورته حتى يفضحه في بيته.
رواه أحمد وأبو داود، وهو صحيح لغيره، ومن شواهده حديث ثوبان عند أحمد برقم : ٢٢٤٠٢ وحديث ابن عمر عند الترمذي برقم : ٢١٥١ وابن حبان في صحيحه برقم : ٥٧٦٣
আবু বারযা আলআসলামী রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ওহে যারা মুখে মুখে ঈমানএনেছ, কিন্তু ঈমান তাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি তারা শোন, মুসলমানের গীবত করো না এবং তাদের দোষত্রুটি অন্বেষণ করোনা। কারণ যে তাদের দোষ খুঁজবে স্বয়ং আল্লাহ তার দোষ খুঁজবেন। আর আল্লাহ যার দোষ খুঁজবেন তাকে তার নিজের ঘরে লাঞ্ছিতকরবেন।’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৯৭৭৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৮৮০ 
এ সকল হাদীসের শিক্ষা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য এক হাদীসে এক বাক্যে ইরশাদ করেছেন-
المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده
অর্থ : মুসলিম সে, যার মুখ ও হাত থেকে সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১০
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর হক আদায়ের সাথে বান্দার হকও আদায় করে সে-ই প্রকৃত মুসলিম।
ইমাম নববী রাহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন-
فيه جمل من العلم، ففيه الحث على الكف عما يؤذي المسلمين، بقول أو فعل، بمباشرة أو سبب، وفيه الحث على الإمساك عن احتقارهم، وفيه الحث على تألُّف قلوب المسلمين واجتماع كلمتهم، واستجلاب ما يُحصّل ذلك. قال القاضي عياض : والألفة إحدى فرائض الدين وأركان الشريعة، ونظام شَمْل الإسلام.
 ‘‘এ হাদীসে রয়েছে অনেক ইলম : যেমন-নিজের কথা বা কাজের মাধ্যমে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো মুসলিমকে কষ্ট নাদেওয়ার আদেশ, কোনো মুসলিমকে উপহাস ও তাচ্ছিল্য না করার আদেশ, মুসলমানদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠার এবং এর জন্যসহায়ক সকল পন্থা অবলম্বনের আদেশ ইত্যাদি।
কাযী ইয়ায রাহ. বলেছেন, ‘সম্প্রীতি দ্বীনের অন্যতম ফরয, শরীয়তের অন্যতম রোকন এবং বৈচিত্রে পূর্ণ মুসলিমসমাজকেএকতাবদ্ধ করার উপায়’।’’-শরহু সহীহ মুসলিম ২/১০, বৈরুত
এই সকল হাদীসে যে হকগুলো বর্ণিত হয়েছে তা মুসলমানের সাধারণ হক। তা পাওয়ার জন্য মুমিন ও মুসলিম হওয়া ছাড়া আরকোনো শর্ত নেই। সুতরাং দুজন মুসলিমের মাঝে বা দুই দল মুসলমানের মাঝে কোনো দ্বীনী বা দুনিয়াবী বিষয়ে মতভেদ হলেসেখানেও এ সকল হক রক্ষা করতে হবে এবং শরীয়তের এ সকল বিধান মেনে চলতে হবে।
কোনো হাদীসে বলা হয়নি যে, দুই মুসলিমের মাঝে মতভেদ হলে তখন আর এ সকল হক রক্ষা করতে হবে না; বরং সেটিই তোআসল ক্ষেত্র এই হকগুলো রক্ষা করার। সাধারণত মতপার্থক্য দেখা দিলেই এই হকগুলো বিনষ্ট করা হয়। সুতরাং ঐ ক্ষেত্রেই যদিসকলে তা রক্ষায় সতর্ক না হয় তাহলে আর সুন্নাহর অনুসরণ এবং হাদীস মোতাবেক আমলের কী অর্থ থাকে?
ইত্তিবায়ে সুন্নতের বিষয়ে এ হাদীস সবাই জানি-
من أحب سنتي فقد أحبني، ومن أحبني كان معي في الجنة.
 ‘যে আমার সুন্নতকে ভালবাসে সে আমাকে ভালবাসে। আর যে আমাকে ভালবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।’
কিন্তু এটি একটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ। পূর্ণ হাদীসটি এই-
عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال : قال لي رسول الله صلى الله عليه و سلم : يا بني إن قدرت أن تصبح وتمسي وليس في قلبك غش لأحد فافعل، ثم قال لي : يا بني وذلك من سنتي ومن أحيا سنتي فقد أحبني ومن أحبني كان معي في الجنة.
رواه الترمذي في كتاب العلم، وقال: هذا حديث حسن غريب من هذا الوجه.
আনাস রা.কে সম্বোধন করে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘বেটা! সকাল-সন্ধ্যায় যদি এমনভাবেথাকতে পার যে, তোমার মনে কারো প্রতি বিদ্বেষ নেই তাহলে এমনভাবেই থাক। বেটা! এটি আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নতকেযিন্দা করে সে আমাকে ভালবাসে। আর যে আমাকে ভালবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।’-জামে তিরমিযী, হাদীস :২৬৭৮
এই সুন্নতের সম্পর্ক যেহেতু অন্তর্জগতের সাথে, তাই এর আলোচনা কম হয়ে থাকে। আমাদের কর্তব্য, ইত্তিবায়ে সুন্নতের সময়এ সুন্নতটি যেন না ভুলি এবং হাদীস অনুসরণের আহবানের সময় এ হাদীসটি যেন বিস্মৃত না হই। আল্লাহ তাআলা আমাদেরসকলকে তাওফীক দান করুন। আমীন।
এবার আমরা ঐক্য ও সম্প্রীতির অপরিহার্যতা এবং কলহ-বিবাদের বর্জনীয়তা সম্পর্কে কিছু হাদীস উল্লেখ করছি। (এ বিষয়েওহাদীসের বিভিন্ন কিতাব থেকে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু একটি হাদীস তুলে দেওয়া হল।)
عن النعمان بن بشير رضي الله تعالى عنه قال : قال النبي صلى الله عليه وسلم  على المنبر : من لم يشكر القليل لم يشكر الكثير، ومن لم يشكر الناسَ لم يشكر الله عز وجل، والتحدُّث بنعمة شكر، وتركها كفر، والجماعة رحمة، والفرقةُ عذاب.
قال المنذري في الترغيب : بإسناد لا بأس به.
নুমান ইবনে বাশীর রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বারের বয়ানে বলেছেন, যে অল্প কিছুর উপর শোকরগোযারীকরে না সে অনেক কিছুর উপরও শোকরগোযারি করে না। যে মানুষের শোকর করে না সে আল্লাহরও শোকর করে না। নেয়ামতপেয়ে তা বর্ণনা করাও শোকরগোযারি আর তা না করা নেয়ামতের না-শোকরী। জামাআ হল রহমত আর বিচ্ছিন্নতা হচ্ছেআযাব।-যাওয়াইদুল মুসনাদ, হাদীস : ১৮৪৪৯, ১৯৩৫০; কিতাবুস সুন্নাহ, ইবনু আবী আসিম, হাদীস : ৯৩
মুসলমানের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য অনেক নীতি ও বিধান দেওয়া হয়েছে।ইসলামের এ সকল বিধানের উপর সংক্ষেপে নজর বুলিয়ে গেলেও পরিষ্কার হয়ে যায়, বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা পরিহার করা ইসলামেরদৃষ্টিতে কত গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবারে পুরুষকে কর্তা বানানো হয়েছে এবং স্ত্রী ও সন্তানদেরকে তার অনুগত থাকার আদেশ করা হয়েছে। আত্মীয়তার সম্পর্কঅক্ষুণ্ণ রাখতে বলা হয়েছে। জাতির সকল শ্রেণীর হক ও অধিকার নির্ধারণ করে এককে অপরের সাথে যুক্ত করা হয়েছে এবংদ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে-
كلكم راع وكلكم مسؤول عن رعيته
প্রত্যেকেই তোমরা দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার অধীনস্তদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।
অন্যদিকে একে অপরকে সালাম দেওয়া, অসুস্থকে দেখতে যাওয়া এবং এ জাতীয় সাধারণ হক সম্পর্কে সচেতন করে সৌহার্দ্য ওসম্প্রীতির বীজ বপন করা হয়েছে।
সফরে বের হলে একজনকে আমীর বানানোর আদেশ করা হয়েছে। সুলতান ও তার স্থলাভিষিক্ত, যারা উলূল আমরের অন্তর্ভুক্ত,তাদের অনুগত থাকার জোরালো আদেশ করা হয়েছে। তবে এখানে শরীয়তের এ বিধানও আছে যে-
لا طاعة لمخلوق في معصية الله عز وجل
অর্থ : আল্লাহর অবাধ্য হয়ে মাখলুকের আনুগত্য বৈধ নয়।
ছোট ব্যক্তি, বড় ব্যক্তি, ক্ষুদ্র সমাজ, বৃহৎ সমাজ সবার আনুগত্যের ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য।
মসজিদের জামাতে ইমামের অনুসরণ জরুরি। তার আগে দাঁড়ানো বা তার আগে কোনো রোকন আদায় করা নিষেধ। কাতারসোজা করা ওয়াজিব। কাতার বাঁকা হলে আছে মনের ঐক্য অন্তর্হিত হওয়ার হুঁশিয়ারি।
দ্বীন-দুনিয়ার যে কোনো যৌথ কাজে আছে শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের বিধান এবং উম্মাহর সকল শ্রেণীর জন্য রয়েছে এই গুরম্নত্বপূর্ণনীতি- وأمرهم شورى بينهم ও
تعاونوا على البر والتقوى، ولا تعاونوا على الإثم والعدوان
কওমকে বলেছে আলিমের কাছে যাও এবং মাসাইল জিজ্ঞাসা করে সে অনুযায়ী চল। আরো বলা হয়েছে, দ্বীনদার, নেককারমানুষের সাহচর্য গ্রহণ কর। তালিবানে ইলমকে বলা হয়েছে উস্তাদের সোহবত ও সান্নিধ্য গ্রহণ কর। সর্বোপরি দ্ব্যর্থহীন ভাষায়ঘোষণা করা হয়েছে-
ليس منا من لم يُجِلُّ كبيرنا، ويَرْحَمْ صغيرنا، ويَعْرِف لعالمنا.
قال الهيثمي في المجمع : 8/14 : رواه أحمد والطبراني، وإسناده حسن.
অর্থাৎ যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের দয়া করে না এবং আলিমের (হক) অনুধাবন করে না সে আমাদের দলভুক্তনয়।-শরহু মুশকিলিল আছার, হাদীস : ১৩২৮; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২২৭৫৫
قال الهيثمي في المجمع : رواه أحمد والطبراني، وإسناده حسن.
-মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/১৪
উম্মাহর প্রত্যেক ব্যক্তিকে এই দীক্ষা দেওয়া হয়েছে যে-
الدين النصيحة، لله ولرسوله ولكتابه ولأئمة المسلمين وعامتهم.
অর্থাৎ দ্বীন হল ওফাদারি-আল্লাহর সাথে, আল্লাহর রাসূলের সাথে, মুসলমানদের নেতৃবৃন্দের সাথে এবং সাধারণ মুসলমানদেরসাথে।
মোটকথা, যৌথ ও সামাজিক জীবনের বিধিবিধান এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে, যেন সকল ক্ষেত্রে ঐক্য, সম্প্রীতি এবংপারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার এক শান্তিময় পরিবেশ বিরাজ করে। গোটা সমাজ যেন হয় এ হাদীসের জীবন্ত নমুনা-
المسلمون كرجل واحد، إن اشتكى عينه اشتكى كله، وإن اشتكى رأسه اشتكى كله.
অর্থাৎ মুসলিমেরা সকলে মিলে একটি দেহের মতো, যার চোখে ব্যথা হলে গোটা দেহের কষ্ট হয়, মাথায় ব্যথা হলেও গোটাদেহের কষ্ট হয়।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৮৬/৬৭
 এই সুশৃঙ্খল ও শান্তিময় জীবনের সকল উপাদান সংরক্ষণ করতে হবে। কলহ-বিবাদের উপাদানগুলোকে ক্রিয়াশীল হতে দেওয়াযাবে না এবং শান্তির সমাজে অশান্তির আগুন জ্বলতে দেওয়া যাবে না। এটি ঐ হাদীসের দাবি, যাতে বলা হয়েছে, ‘জামাআ হচ্ছেরহমত আর ফুরকা হচ্ছে আযাব।’ নববী ও কাযী ইয়াযের যে কথাগুলো ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে তাতেও এদিকে ইঙ্গিতরয়েছে।
জামাআতে শামিল থাকার বিষয়ে অনেক হাদীস ও আছার রয়েছে, যা পাওয়া যাবে হাদীসগ্রন্থের কিতাবুল ফিতান, কিতাবুলইমারাহ, কিতাবুল ইতিসাম বিলকিতাবি ওয়াস সুন্নাহ প্রভৃতি অধ্যায়ে।
এসকল হাদীস সামনে রেখে চিন্তা করলে প্রতীয়মান হয়, আলজামাআ শব্দে নিমেণাক্ত বিষয়গুলো শামিল আছে :
১. আমীরুল মুমিনীন বা সুলতানের কতৃত্ব স্বীকারকারীদের সঙ্গে থাকা এবং শরীয়তসম্মত বিষয়ে তার আনুগত্য বর্জন না করা।(দ্রষ্টব্য : ফাতহুল বারী ১৩/৩৭, হাদীস : ৭০৮৪-এর আলোচনায়)
২. শরীয়তের আহকাম ও বিধানের ক্ষেত্রে উম্মাহর ‘আমলে মুতাওয়ারাছ’ তথা সাহাবা-তাবেয়ীন যুগ থেকে চলে আসা কর্মধারাএবং উম্মাহর সকল আলিম বা অধিকাংশ আলিমের ইজমা ও ঐক্যের বিরোধিতা না করা। (দ্রষ্টব্য : উসূলের কিতাবসমূহেরইজমা অধ্যায়)
৩. হাদীস-সুন্নাহ এবং ফিকহের ইলম রাখেন, এমন উলামা-মাশাইখের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখা। ইমাম তিরমিযী রাহ. আহলেইলম থেকে আলজামাআর যে ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছেন তা এই-
أهل الفقه والعلم والحديث
অর্থাৎ জামাআ হচ্ছে ফিকহ ও হাদীসের ধারক আলিম সম্প্রদায়। (কিতাবুল ফিতান, বাবু লুযুমিল জামাআ, হাদীস : ২১৬৭-এরআলোচনায়)
৪. মুসলিমসমাজের ঐক্য, সংহতি এবং ঈমানী ভ্রাতৃত্বের উপাদানসমূহের সংরক্ষণ এবং অনৈক্য, বিবাদ ও হানাহানিরউপকরণসমূহ থেকে সমাজকে মুক্ত করার প্রয়াস, যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে বলা হয়েছে।
এখানে যে চারটি বিষয় উল্লেখ করা হল সাধারণত আলজামাআর ব্যাখ্যায় এগুলোকে আলাদা আলাদা মত হিসেবে বর্ণনা করাহয়। কিন্তু বাস্তবে এদের মাঝে কোনো সংঘর্ষ নেই। প্রত্যেকটি হচ্ছে আলজামাআর বিভিন্ন দিক। একেকজন একেকটি দিকআলোচনা করেছেন।
একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা
এখানে যে কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা এই যে, উপরোক্ত হাদীসসমূহে ‘আলজামাআ’র বিপরীতে এসেছে ‘আলফুরকা’; ‘আলইখতিলাফ’ নয়। অনেকে ফুরকা বা বিচ্ছিন্নতা শব্দের তরজমা করে ফেলেন ইখতিলাফ বা মতভেদ। এই তরজমাআপত্তিকর। সামনে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ। 
মতভেদ কখন বিভেদ হয়
উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস থেকে ঐক্য ও সম্প্রীতির গুরুত্ব যেমন বোঝা যায় তেমনি বোঝা যায়, সকল মতভেদ বিভেদ নয়।কারণ কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট বর্ণনা অনুযায়ী নবী ও রাসূলদের মাঝে কোনো বিভেদ ছিল না। তারা পরস্পর অভিন্ন ছিলেন।যদিও শরীয়তের বিধিবিধান সবার এক ছিল না, পার্থক্য ও বিভিন্নতা ছিল। কিন্তু তা ছিল দলিলভিত্তিক, খেয়ালখুশি ভিত্তিক-নাউযুবিল্লাহ- ছিল না। সুতরাং বোঝা গেল, ফুরূ বা শাখাগত বিষয়ে দলিলভিত্তিক মতপার্থক্য বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা নয়।
সবাই জানেন, দাউদ আ. ছিলেন আল্লাহর নবী। তাঁর পুত্র সুলায়মান আ.ও নবী ছিলেন। এক মোকদ্দমার রায় সম্পর্কে দুজনেরমাঝে ইজতিহাদগত মতপার্থক্য হল। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে তাদের মতপার্থক্যের দিকে ইঙ্গিত করেছেন এবংসুলায়মান আ.-এর ইজতিহাদ যে তাঁর মানশা মোতাবেক ছিল সেদিকেও ইশারা করেছেন। তবে পিতাপুত্র উভয়ের প্রশংসাকরেছেন। তো এখানে ইজতিহাদের পার্থক্য হয়েছে, কিন্তু বিভেদ হয়নি। এই পার্থক্যের আগেও যেমন পিতাপুত্র দুই নবী একছিলেন, তেমনি পার্থক্যের পরও।
(দেখুন : সূরা আম্বিয়া (২১) : ৭৮-৭৯)
তাফসীরে ইবনে  কাসীর, তাফসীরে কুরতুবী (১১/৩০৭-৩১৯) ও অন্যান্য তাফসীরের কিতাব দেখে নেওয়া যায়।
তো বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার ছূরতগুলো ভালোভাবে জেনে নেওয়া চাই। আর তা এই-
১. দ্বীন ইসলামে দাখিল না হওয়া, ইসলামের বিরোধিতা করা বা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া-এগুলো সর্বাবস্থায় দ্বীনেরক্ষেত্রে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা।
তাওহীদ এবং দ্বীনের অন্যান্য মৌলিক বিষয়, যেগুলোকে পরিভাষায় ‘জরূরিয়াতে দ্বীন’ বলে, তার কোনো একটির অস্বীকার বাঅপব্যাখ্যা হচ্ছে ইরতিদাদ (মুরতাদ হওয়া), যা দ্বীনের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতার জঘন্যতম প্রকার। এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় দ্বীনইসলামকে মনে প্রাণে গ্রহণ করা।
২. দ্বীনে ইসলাম গ্রহণের পর কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী আকীদাসমূহ বোঝার ক্ষেত্রে খেয়ালখুশির অনুসরণ করে সাহাবীগণেরপথ থেকে বিচ্যুত হওয়া। এটাও বিচ্ছিন্নতা। হাদীস শরীফে কঠিন ভাষায় এর নিন্দা করা হয়েছে এবং তা থেকে বাঁচার জন্য দুটিজিনিসকে দৃঢ়ভাবে ধারণের আদেশ করা হয়েছে : ‘আসসুন্নাহ’ এবং ‘আলজামাআ’। এ কারণে যে জামাত সিরাতে মুসতাকীমেরউপর অটল থাকে তাদের নাম ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ।’
তাদের পথ থেকে যারাই বিচ্যুত হয়েছে তারাই এই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়েছে। অতপর কোনো দল ও ফের্কার জন্ম দিলেতা তো আরো মারাত্মক।
৩. আলজামাআর ব্যাখ্যায় উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির প্রসঙ্গে প্রথম যে বিষয়ের কথা বলা হয়েছে তার কোনো একটি ভঙ্গ করাকিংবা কোনো একটি থেকে বিচ্যুত হওয়া পরিষ্কার বিচ্ছিন্নতা।
আর ‘আলজামাআর’ ব্যাখ্যায় উল্লেখিত চতূর্থ বিষয়টি অর্থাৎ মুসলিম সমাজের ইজতিমায়ী রূপরেখা বিনষ্ট করা বা এমন কোনোপদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে তা বিনষ্ট হয় তাও বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শামিল।
ফুরূয়ী মাসাইল বা শাখাগত বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগণের যে মতপার্থক্য, যাকে ফিকহী মাযহাবের মতপার্থক্য বলে, তা দ্বীনেরবিষয়ে বিচ্ছিন্নতা নয়। আগেও এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কারণ ফিকহের এই মাযহাবগুলো তো আহলুস সুন্নাহ ওয়ালজামাআর ইমামগণেরই মাযহাব। এগুলো ‘বিচ্ছিন্নতা নয়; বরং গন্তব্যে পৌঁছার একাধিক পথ, যা স্বয়ং গন্তব্যের মালিকের পক্ষহতে স্বীকৃত ও অনুমোদিত। ফির্কা ও ফিকহী মাযহাবের পার্থক্য বুঝতে ব্যর্থ হওয়া খুবই দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক বিষয়।
সাহাবায়ে কেরামের যুগেও ফিকহের মাযহাব ও ফিকহের মতপার্থক্য ছিল, অথচ তাঁরা খেয়ালখুশির মতভেদ কখনো সহ্যকরতেন না। তাদের কাছে এ জাতীয় মতভেদকারীদের উপাধি ছিল ‘আহলুল আহওয়া’, ‘আহলুল বিদা ওয়াদ দ্বলালাহ’ এবং‘আহলুল বিদআতি ওয়াল ফুরকা’।
সাহাবায়ে কেরামের যুগে ফিকহের মাযহাব
এ সম্পর্কে ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর বিবরণ শুনুন :
ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. (১৬১ হি.-২৩৪ হি.) ছিলেন ইমাম বুখারী রাহ.-এর বিশিষ্ট উস্তাদ। তিনি সাহাবায়ে কেরামেরসেসব ফকীহের কথা আলোচনা করেছেন, যাদের শাগরিদগণ তাঁদের মত ও সিদ্ধান্তগুলো সংরক্ষণ করেছেন, তা প্রচার প্রসারকরেছেন এবং যাদের মাযহাব  তরীকার  উপর আমল  ফতওয়া জারি ছিল। আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. এই প্রসঙ্গেবলেছেন, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে এমন ব্যক্তি ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. (মৃত্যু : ৩২ হিজরী), যায়েদ ইবনে ছাবিত রা. (জন্ম : হিজরতপূর্ব ১১ ও মৃত্যু : ৪৫ হিজরী) ও আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. (জন্ম : হিজরতপূর্ব ৩ ও মৃত্যু : ৬৮ হিজরী)।
তাঁর আরবী বাক্যটি নিমণরূপ-
ولم يكن في أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم من له صُحَيْبَةٌ، يذهبون مذهبه، ويفتون بفتواه ويسلكون طريقته، إلا ثلاثة : عبد الله بن مسعود وزيد بن ثابت وعبد الله بن عباس رضي الله عنهم، فإن لكل منهم أصحابا يقومون بقوله ويفتون الناس.
এরপর আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. তাঁদের প্রত্যেকের মাযহাবের অনুসারী ও তাঁদের মাযহাব মোতাবেক ফতওয়া দানকারী ফকীহতাবেয়ীগণের নাম উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর কিরাত অনুযায়ীমানুষকে কুরআন শেখাতেন, তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মানুষকে ফতওয়া দিতেন এবং তাঁর মাযহাব অনুসরণ করতেন তারা হলেনএই ছয়জন মনীষী : আলকামাহ (মৃত্যু : ৬২ হিজরী), আসওয়াদ (মৃত্যু : ৭৫ হিজরী), মাসরূক (মৃত্যু : ৬২ হিজরী), আবীদাহ (মৃত্যু: ৭২ হিজরী), আমর ইবনে শুরাহবীল (মৃত্যু : ৬৩ হিজরী) ও হারিস ইবনে কাইস (মৃত্যু : ৬৩ হিজরী)।
ইবনুল মাদীনী রাহ. বলেছেন, ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. (৪৬-৯৬ হিজরী) এই ছয়জনের নাম উল্লেখ করেছেন।
ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর উপরোক্ত বিবরণের সংশ্লিষ্ট  আরবী পাঠ নিমণরূপ-
الذين يقرؤن الناس بقراءته ويفتونهم بقوله وبذهبون مذهبه ...
এরপর আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. লিখেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর (ফকীহ) শাগরিদদের সম্পর্কে এবং তাঁদেরমাযহাবের বিষয়ে সবচেয়ে বিজ্ঞ ছিলেন ইবরাহীম (নাখায়ী) (৪৬-৯৬ হিজরী) এবং আমের ইবনে শারাহীল শাবী (১৯-১০৩হিজরী)। তবে শাবী মাসরূক রাহ.-এর মাযহাব অনুসরণ করতেন।
আরবী পাঠ নিমণরূপ-
وكان أعلم أهل الكوفة بأصحاب عبد الله ومذهبهم إبراهيم والشعبي إلا أن الشعبي كان يذهب مذهب مسروق.
এরপর লিখেছেন-
وكان أصحاب زيد بن ثابت الذين يذهبون مذهبه في الفقه ويقومون بقوله هؤلاء الاثنى عشر ...
অর্থাৎ যায়েদ ইবনে ছাবিত রা.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর মাযহাবের অনুসারী ছিলেন এবং তাঁর মত ও সিদ্ধান্তসমূহ সংরক্ষণ ওপ্রচার প্রসার করতেন তাঁরা বারো জন।
তাঁদের নাম উল্লেখ করার পর ইবনুল মাদীনী রাহ. লেখেন, এই বারো মনীষী ও তাদের মাযহাবের বিষয়ে সবচেয়ে বিজ্ঞ ছিলেনইবনে শিহাব যুহরী (৫৮-১২৪ হিজরী), ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ আনসারী (মৃত্যু : ১৪৩ হিজরী), আবুয যিনাদ (৬৫-১৩১ হিজরী)এবং আবু বকর ইবনে হাযম (মৃত্যু ১২০ হিজরী)।
এদের পরে ইমাম মালেক ইবনে আনাস রাহ. (৯৩-১৭৯ হিজরী)।
এরপর ইবনুল মাদীনী রাহ. বলেছেন-
‘তদ্রূপ আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর মত ও সিদ্ধান্তসমূহ সংরক্ষণ ও প্রচার করতেন, সে অনুযায়ীফতওয়া দিতেন এবং তার অনুসরণ করতেন, তাঁরা ছয়জন।
وكما أن أصحاب ابن عباس ستة الذين يقومون بقوله ويفتون به ويذهبون مذهبه.
এরপর তিনি তঁদের নাম উল্লেখ করেন।
ইমাম ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর পূর্ণ আলোচনা তাঁর ‘কিতাবুল ইলালে’ (পৃষ্ঠা : ১০৭-১৩৫, প্রকাশ : দারুবনিল জাওযী রিয়ায,১৪৩০ হিজরী।) বিদ্যমান আছে এবং ইমাম বায়হাকী রাহ.-এর ‘আলমাদখাল ইলাস সুনানিল কুবরা’তেও (পৃষ্ঠা : ১৬৪-১৬৫)সনদসহ উল্লেখিত হয়েছে। আমি উক্তিটি দোনো কিতাব সামনে রেখেই উদ্ধৃত করেছি। এই কথাগুলো আলোচ্য বিষয়ে এতই স্পষ্টযে, কোনো টীকা-টিপ্পনীর প্রয়োজন নেই। সুতরাং মনে রাখতে হবে, ইমামগণের ফিকহী মাযহাবের যে মতপার্থক্য তাকে বিভেদমনে করা অন্যায় ও বাস্তবতার বিকৃতি এবং সাহাবায়ে কেরামের নীতি ও ইজমার বিরোধিতা। আর এ পার্থক্যের বাহানায় মাযহাব অনুসারীদের থেকেআলাদা হয়ে তাদের নিন্দা-সমালোচনা করা সরাসরি বিচ্ছিন্নতা, যা দ্বীনের বিষয়ে বিভেদের অন্তর্ভুক্ত।
মাযহাবকে আসাবিয়াতের কারণ বানানো
তেমনি ফিকহী মাযহাবের অনুসারী কোনো ব্যক্তি বা দল যদি মাযহাবকে জাহেলী আসাবিয়াত ও দলাদলির কারণ বানায় তাহলেতার/তাদের এই কাজও নিঃসন্দেহে ঐক্যের পরিপন্থী এবং বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শামিল।
দেখুন, ‘মুহাজিরীন’ ও ‘আনসার’ কত সুন্দর দুটি নাম এবং কত মর্যাদাবান দুটি জামাত। উভয় জামাতের প্রশংসা কুরআন মজীদেরয়েছে। কিন্তু এক ঘটনায় যখন এ দুই নামের ভুল ব্যবহার হয়েছে তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গেসঙ্গে তাম্বীহ করেছেন।
জাবির রা. থেকে বর্ণিত, এক সফরে এক মুহাজির তরুণ ও এক আনসারী তরুণের মাঝে কোনো বিষয়ে ঝগড়া হয়। মুহাজিরআনসারীকে একটি আঘাত করল। তখন আনসারী ডাক দিল, يا للأنصار! হে আনসারীরা!; মুহাজির তরুণও ডাক দিল-يا للمهاجرين! হেমুহাজিররা!; আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আওয়াজ শোনামাত্র বললেন-ما بال دعوى الجاهلية এ কেমন জাহেলীডাক! কী হয়েছে?
ঘটনা বলা হল।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এমন জাহেলী ডাক ত্যাগ কর। এ তো দুর্গন্ধযুক্ত ডাক!
অন্য বর্ণনায় আছে, এতে তো বিশেষ কিছু ছিল না। (কেউ যদি কারো উপর জুলুম করে তাহলে) সকলের কর্তব্য, তার ভাইয়েরসাহায্য করা। সে জুলুম করুক বা তার উপর জুলুম করা হোক। জালিম হলে তাকে বাধা দিবে। এটাই তার সাহায্য। আর মাজলুমহলে তার সাহায্য করবে (জুলুম থেকে রক্ষা করবে)।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪৯০৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৮৪/৬২, ৬৩
হাদীসের অর্থ হচ্ছে, কারো উপর জুলুম হতে থাকলে সাহায্যের জন্য ডাকতে বাধা নেই। কিন্তু ডাকবে সব মুসলমানকে। যেমনউপরোক্ত ঘটনায় আনসারী মুহাজিরদেরকেও ডাকতে পারতেন এবং মুহাজির আনসারীদেরকে ডাকতে পারতেন। কিংবা ভাইসব!মুসলমান ভাইরা! বলেও ডাকা যেত। কিন্তু এমন কোনো ডাক মুসলমানের জন্য শোভন নয়, যা থেকে আসাবিয়ত ও দলাদলিরদুর্গন্ধ আসে। কারণ তা ছিল জাহেলী যুগের প্রবণতা। ঐ সময় সাহায্য ও সমর্থনের ভিত্তি ছিল বংশীয় বা গোত্রীয় পরিচয়।ইসলামে সাহায্যের ভিত্তি হচ্ছে ন্যায় ও ইনসাফ। ইরশাদ হয়েছে-
وتعاونوا على البر والتقوى، ولا تعاونوا على الإثم والعدوان
এ কারণে ইসলামের নিয়ম, জালিমকে আটকাও সে যেই হোক না কেন। হাদীসে আছে-
ليس منا من دعا إلى عصبية، وليس منا من قاتل عصبية، وليس منا من مات على عصبية
 ‘ঐ ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আসাবিয়তের দিকে ডাকে, সেও আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আসাবিয়তের কারণে লড়াই করেএবং সে-ও নয়, যে আসাবিয়তের উপর মৃত্যুবরণ করে।’-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫১২১
অন্য হাদীসে আছে-
يا رسول الله! ما العصبية؟ قال : أن تعين قومك على ظلم.
 ‘আল্লাহর রাসূল! আসাবিয়ত কী? বললেন, নিজের কওমকে তার অন্যায়-অবিচারের বিষয়ে সাহায্য করা।’-সুনানে আবু দাউদ,হাদীস : ৫১১৯
তো ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এই যে, ‘মুহাজির’ ও ‘আনসার’ দুটি আলাদা নাম, আলাদা জামাত, আলাদাপরিচয়-এতে আপত্তির কিছু নেই। আপত্তি তখনই হয়েছে যখন নাম দুটি এমনভাবে ব্যবহার করা হল, যা থেকে আসাবিয়তেরদুর্গন্ধ আসে। এ শিক্ষা ফিকহি মাযহাবের ভিত্তিতে আলাদা জামাত ও আলাদা পরিচয় কিংবা অন্য কোনো বৈধ বা প্রশংসনীয়বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে শ্রেণী ও পরিচয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।  এ নীতি সব ক্ষেত্রেই মনে রাখা উচিত।
কথা দীর্ঘ হয়ে গেল। আমি আরজ করছিলাম, ফুরূয়ী ইখতিলাফকে দ্বীনের বিষয়ে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার মধ্যে দাখিল করা এবংফিকহী মাযহাবের অনুসরণকে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা সাব্যস্ত করা জায়েয নয়।
যে বিষয়গুলো ঐক্যের পরিপন্থী নয়
উপরোক্ত আলোচনায় ঐ বিষয়গুলো সামনে এসেছে, যা উম্মাহর ঐক্যের পরিপন্থী। সংক্ষেপে ঐ বিষয়গুলোও উল্লেখ করে দেওয়াপ্রয়োজন, যেগুলোকে কোনো লোক ঐক্যের পরিপন্থী মনে করতে পারে অথচ তা উম্মাহর ঐক্য রক্ষার জন্যই জরুরি। যেমন :
১. আহলে কুফর ও আহলে শিরক থেকে আলাদা থাকা। তাদের বাতিল বিষয়াদিতে সঙ্গ না দেওয়া। তাদের জাতীয় নিদর্শন ওসংস্কৃতি থেকে দূরে থাকা। তাদের সাথে অন্তরঙ্গতা না রাখা। রাজনৈতিক প্রয়োজনে (মুসলিম উম্মাহর রাজনীতি হবে সর্বদা দ্বীনেরঅধীন) তাদের সাথে সন্ধির প্রয়োজন হলে তা শরীয়তের বিধান মোতাবেক হতে পারে।
২. ‘আহলুল বিদআ ওয়াল ফুরকা’র সাথে তাদের বিদআত ও বিচ্ছিন্নতার বিষয়ে একমত না হওয়া। তালীম-তরবিয়ত, সুলুক ওতাযকিয়ার প্রয়োজনে তাদের সাহচর্য গ্রহণ না করা। কারণ সাহচর্যের দ্বারা মানুষ প্রভাবিত হয়। ‘আহলুল আহওয়া’র সাহচর্যগ্রহণ করার বিষয়ে সাহাবা-তাবেয়ীন নিষেধ করেছেন।
৩. প্রকাশ্যে ফিসক-ফুজুরে লিপ্ত ব্যক্তিদের সংশ্রব থেকে দূরে থাকা।
৪. অন্যায় ও ভুল কাজে কারো সাহায্য না করা। আসাবিয়ত ও দলাদলির ক্ষেত্রে কাউকে সঙ্গ না দেওয়া।
৫. ‘যাল্লাত’( যেসব ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে ভুল হয়েছে এমন) ক্ষেত্রে আকাবির ও মাশাইখের তাকলীদ না করা।
৬. জালিমকে জুলুম থেকে বিরত রাখা।
৭. ওয়াজ-নসীহত
৮. শরীয়তের নীতি ও বিধান অনুযায়ী আমর বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকার করা।
৯. ইলমী আদব রক্ষা করে মতবিনিময়ের উদ্দেশ্যে মতভেদপূর্ণ ইজতিহাদী বিষয়াদিতে দলিলের ভিত্তিতে আলোচনা-পর্যালোচনাকরা।
১০. কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনে শরীক না হওয়া, কিংবা বলুন, পশ্চিমাদের পদ্ধতিতে রাজনীতিকারী কোনো সংগঠনেশামিল না হওয়া।
শাখাগত মতভেদের ক্ষেত্রে সুন্নাহ অনুসরনের সুন্নাহসম্মত পন্থা
ইতিপূর্বের আলোচনায় সম্ভবত স্পষ্ট হয়েছে যে, শরীয়তের শাখাগত বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগণের মতভিন্নতাকে বিভেদ ওবিচ্ছিন্নতা মনে  করা ভুল। কুরআন-সুন্নাহয় যে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাইয়িনাত তথা কিতাব-সুন্নাহরঅকাট্য ও সুস্পষ্ট দলিল থাকার পরও মতভেদ করার যে নিন্দা করা হয়েছে মুজতাহিদ ইমামগণের মতপার্থক্যকে তার অন্তর্ভুক্তকরা প্রকৃতপক্ষে জেনে কিংবা না জেনে  উপরোক্ত নুসূসেরই অপব্যাখ্যা। কেননা এসব নুসূসের উদ্দেশ্য নিষিদ্ধ মতভেদ, যাস্পষ্টত বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা। যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
তবে কোনো ব্যক্তি বা দল যদি শাখাগত মতভিন্নতার ক্ষেত্রে শরীয়তের নীতি ও বিধান অনুসরণ না করে উম্মাহর মাঝেকলহ-বিবাদ ছড়ায় তাহলে সে উম্মতের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবে। তাই আমাদেরকে এসব নীতি ওবিধান জানতে হবে এবং শাখাগত মতভিন্নতার ক্ষেত্রে সুন্নাহ অনুসরণের এবং সুন্নাহর প্রতি দাওয়াতের মাসনুন ও মুতাওয়ারাছতথা সুন্নাহসম্মত ও অনুসৃত পন্থা জানতে হবে। যেন ঐসব নীতি ও বিধানের বিরোধিতার কারণে বিচ্ছিন্নতার শিকার না হয়ে যাই।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, কোনো কোনো বন্ধু বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার আয়াত ও হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়ালজামাআর ইমামদের ফিকহী মাযহাবের উপর বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তির আপত্তি তুলছেন তারা একটুও চিন্তা করছেন না যে,নির্ভরযোগ্য ফিকহি মাযহাবের মতভিন্নতা সম্পূর্ণ বৈধ ও শরীয়তসম্মত। এটি নিষিদ্ধ বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার আওতাভুক্ত নয়।অন্যদিকে তারা হাদীস ও সুন্নহার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকারী ফিকহের মাযহাবগুলোকে হাদীসের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে তার সম্পর্কেলোকদেরকে বিরূপ করে এবং বৈধ মতভিন্নতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তারা নিজেরাই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতায় লিপ্ত। এজন্য প্রথমে শাখাগতবিষয়ে ফিকহের ইমামগণের মতভিন্নতার প্রকার ও বিধান সম্পর্কে আলোচনা করা উচিত।
ফিকহি মাসায়েলের প্রকারসমূহ
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর যে কোনো ফিকহী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে, সকলমাসায়েল মৌলিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত : ১. ঐ সকল মাসাইল, যার বিধান সকল মাযহাবে এক ও অভিন্ন। যেমন-পাঁচ ওয়াক্তনামায ফরয, সর্বমোট সতের রাকাত নামায ফরয, প্রতি রাকাতে একটি রুকু ও দুইটি সিজদা, তাকবীরে তাহরীমার মাধ্যমেনামায শুরু হয় এবং সালামের মাধ্যমে শেষ হয় ইত্যাদি। ইবাদত থেকে মীরাছ পর্যন্ত শত শত নয়; হাজার হাজার মাসআলাআছে, যা ‘মুজমা আলাইহি’। অর্থাৎ এসব মাসআলায় গোটা উম্মাহর; বা বলুন, মুজতাহিদ ইমামগণের ইজমা রয়েছে। আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাআর কোনো নির্ভরযোগ্য কিতাবে ভিন্ন বিধান পাওয়া যাবে না।
এসব বিষয়ে ইজমা এ কারণেই হয়েছে যে, এই বিধানগুলো হয়তো কোনো আয়াত বা মুতাওয়াতির সুন্নাহয় সরাসরি বিদ্যমানআছে। কিংবা এমন কোনো সহীহ হাদীসে আছে, যা উসূলে হাদীসের মানদন্ডে দলিলযোগ্য হওয়ার বিষয়ে হাদীস বিচারকমুহাদ্দিসদের মাঝে কোনো মতভিন্নতা নেই। অথবা সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগে কিংবা পরবর্তী ফকীহগণের মাঝে ঐ বিষয়ে ইজমাসংগঠিত হয়েছিল।
২. ঐ সকল মাসাইল, যাতে ইমামগণের মাঝে মতভিন্নতা রয়েছে।
এই মতভিন্নতা সম্পর্কে কিছু মানুষের মাঝে এই কু-ধারণা লক্ষ্য করা যায় যে, এ মতভিন্নতার সূচনা হয়েছে খায়রুল কুরুনেরপর। আর তা হয়েছে হাদীস বিষয়ে ইমামগণের অজ্ঞতা কিংবা হাদীস অনুসরণে অনীহার কারণে। অথচ ইসলামী ফিকহেরইতিহাস যারা পড়েছেন এবং মুজতাহিদ ইমামগণের মর্যাদা, ইলম-আমল ও খোদাভীরুতা সম্পর্কে যারা অবগত অথবা অন্ততফিকহের দীর্ঘ ও দলিল-প্রমাণের আলোচনা সম্বলিত কিতাবাদি অধ্যয়নের সুযোগ যাদের হয়েছে তারা জানেন, এই কুধারণা কতজঘণ্য ও অবাস্তব।   
বাস্তবতা এই যে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ফিকহের নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহে যেসব মাসআলায় মতভিন্নতা পাওয়া যায়তার অধিকাংশেই সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের যুগ থেকেই মতভিন্নতা চলে আসছে কিংবা বিষয়টিই এমন যাতে কোনোআয়াত বা সহীহ হাদীস নেই, এমনকি এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা অথবা কোনো আছারও পাওয়া যায় না। মুজতাহিদইমামগণ শরঈ কিয়াসের ভিত্তিতে ইজতিহাদ করে এসব সমাধান বের করেছেন।
হ্যাঁ, ফিকহের কিতাবসমূহে হাতে গোনা কিছু মাসআলা পাওয়া যাবে, যেগুলোকে ‘যাল্লাহ’ (বিচ্যুতি), শায, কিংবা আলইখতিলাফুগায়রুস সায়েগ (অগ্রহণযোগ্য মতভেদ) বলা হয়। এসব মাসআলায় কোনো মুজতাহিদ থেকে নিশ্চিত ভ্রান্তি হয়ে গেছে। এজন্যউসূলে ফিকহ ও উসূলে ইফতার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, এসব মাসআলা ‘মামুল বিহী ফিকহ’ (আমলযোগ্য ফিকহ) ও ‘মুফতাবিহী কওল’ (ফতওয়া প্রদানযোগ্য সিদ্ধান্ত) নয়। কোনো মাযহাবের দায়িত্বশীল কোনো মুফতী এসব মাসআলা অনুযায়ী ফতওয়াপ্রদান করেন না। এ ধরনের হাতে গোনা কিছু মাসআলা ছাড়া ফিকহের সকল মতভেদপূর্ণ মাসআলা তিন প্রকারে বিভক্ত।
প্রথমে তিন প্রকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পেশ করব। এরপর প্রত্যেকটির উপর বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রে মতভেদ
অর্থাৎ কোনো ইবাদতের পদ্ধতি (যেমন-নামায, হজ্ব ইত্যাদি) সম্পর্কিত এমন কিছু পার্থক্য, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম-এর যুগেও ছিল এবং খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরামের যুগেও ছিল। কারণ এসব ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেই একাধিক সুন্নাহ বা পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। আর সাহাবায়ে কেরামের মাঝেও উভয় পদ্ধতিঅনুসারেই কমবেশি আমল হয়েছে। এভাবে পরবর্তী যুগেও উভয় পদ্ধতি অনুযায়ী আমল হয়েছে। এ ধরনের মতভিন্নতার অপরনাম ‘ইখতিলাফুত তানাওউ’ অর্থাৎ সুন্নাহর বিভিন্নতার কারণে মতভিন্নতা। আরেক নাম ‘আলইখতিলাফুল মুবাহ’ অর্থাৎ এমনমতপার্থক্য, যার উভয় পদ্ধতি সকল মুজতাহিদের নিকট বৈধ।
দলিলের মর্মোদ্ধারগ্রহণযোগ্যতা বিচার  দলিলসমূহের পরস্পর বিরোধের ক্ষেত্রে মতভেদ
অর্থাৎ কোনো বিষয়ের বিধান কোনো আয়াত বা হাদীস থেকে গ্রহণ করা যায়, তবে ঐ আয়াত বা হাদীসটি ঐ সিদ্ধান্তের জন্য‘নসসে মুহকাম’ নয়। অর্থাৎ আরবী ভাষার নিয়ম-কানুন ও মর্মোদ্ধারের নীতিমালা, এক শব্দে বললে, উসূলে ফিকহের নীতিমালাঅনুযায়ী এ আয়াত বা হাদীসে একাধিক অর্থের বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে মুজতাহিদ ইমাম কিংবা ফকীগণের মাঝেমতভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে।   
আবার এমনও হয় যে, মাসআলার বিধান সম্পর্কে কোনো হাদীস আছে, কিন্তু ইলমুল ইসনাদ বা উসূলে হাদীসের নীতিমালাঅনুযায়ী তা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত কি না; পারিভাষিক শব্দে বললে, ঐ হাদীসটি সহীহবা দলিলযোগ্য কি না-এ বিষয়ে হাদীস বিচারক মুহাদ্দিসগণের মাঝে মতভিন্নতা আছে।
প্রসঙ্গত মনে রাখা উচিত, মুজতাহিদ ইমামগণও হাফিযুল হাদীস হয়ে থকেন এবং হাদীস বিচারেও পারদর্শী হয়ে থাকেন। 
হাদীসটি যেহেতু এমন যে, ইলমুল হাদীসের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সহীহ, অন্য সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যয়ীফ বা মালুল কিংবা শায ওমুনকার তাই যে ইমাম হাদীসটি সহীহ মনে করেছেন তিনি এই মাসআলায় এক ধরনের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আর যিনি একেদলিল হওয়ার যোগ্য মনে করেননি তিনি অন্য কোনো দলিল দ্বারা, যেমন-কোনো সাহাবী বা তাবেয়ীর আছর দ্বারা কিংবা শরঈকিয়াস দ্বারা ইজতিহাদ করে সমাধান দিয়েছেন এবং তার সিদ্ধান্ত ভিন্ন হয়েছে। 
তো সারকথা এই যে, এই প্রকারের মাসআলায় কুরআন-হাদীসের দলিল বিদ্যমান থাকার পরও মতভেদ হয়েছে। কারণ সংশ্লিষ্টআয়াতটি নসসে মুহকাম নয়। আর হাদীসটি হয়তো সর্বসম্মত সহীহ নয় অর্থাৎ তার সহীহ হওয়ার বিষয়টি স্বয়ং হাদীসবিচারকদের মাঝেই মতভেদপূর্ণ। অথবা তা নসসে মুহকাম নয়। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট মাসআলায় তা দ্ব্যর্থহীন নয়, একাধিক অর্থেরসম্ভাবনা রয়েছে। 
দলিলের বিশুদ্ধতা বা অর্থের ক্ষেত্রে যেখানে মতভেদের অবকাশ রয়েছে সেখানে মুজতাহিদ ইমাম ও ফকীহগণকে সংশ্লিষ্টসমস্যার সমাধান ইজতিহাদের মাধ্যমেই করতে হয়।
এরচেয়েও জটিল বিষয় হল বিভিন্ন দলিলের বিরোধ। অর্থাৎ যেসব মাসআলায় মুজতাহিদ ফকীহ তার সামনে বিদ্যমানদলিলসমূহের মাঝে বিরোধ অনুভব করেন সেখানে মাসআলার বিধান নির্ণয়ের জন্য তাঁকে ঐ বিরোধ নিরসন করতে হয়। আরএর জন্য যে কাজগুলো করতে হয় তার পারিভাষিক নাম এই :
১. الجمع বা التطبيق (সমন্বয়)।
২. الترجيح বা معرفة الراجح والمرجوح (অগ্রগণ্য নির্ণয়)।
৩. النسخ বা معرفة الناسخ والمنسوخ (নাসিখ-মানসূখ নির্ণয়)।
দলিলসমূহের বিশ্লেষণ ও তা থেকে বিধান গ্রহণের সময় এই তিনটি কাজ একজন মুজতাহিদ ফকীহকে করতে হয়। আর কাজতিনটি করা হয় ইজতিহাদের ভিত্তিতে। যার দরুণ মুজতাহিদ ফকীগণের মাঝে এই কাজগুলো সম্পন্ন করে মাসআলার বিধাননির্ধারণের ক্ষেত্রে মতভিন্নতা হয়ে থাকে।
এটি অতি দীর্ঘ ও গভীর একটি বিষয়। সংক্ষিপ্ত আলোচনার জন্যও দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রয়োজন। এখানে শুধু ইঙ্গিত করা হল।
রায়  কিয়াসের বিভিন্নতাজনিত মতভেদ
অর্থাৎ ঐ সকল নতুন সমস্যা, যা নবী-যুগ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগের পরে সৃষ্টি হয়েছে, যার সমাধান না কোনো আয়াতেউল্লেখিত হয়েছে, না কোনো হাদীসে, আর না এ বিষয়ে পূর্ববর্তী ফকীগণের ইজমা আছে। এক্ষেত্রে যা আছে তা হল, কোনোসাহাবীর আছর বা কোনো তাবেয়ীর কোনো ফতওয়া এবং তাতেও দুই মত অথবা এর সমাধান কোনো সাহাবী বা বড় তাবেয়ীরআছরেও পাওয়া যায় না। এ ধরনের বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগণকে ‘রায়’ ও শরঈ কিয়াসের দ্বারা ইজতিহাদ করতে হয়েছে। আরইজতিহাদের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
উপরোক্ত উভয় প্রকারের মাসআলাকে (অর্থাৎ যেসব মাসআলায় দলিলের গ্রহণযোগ্যতা বিচার কিংবা মর্মোদ্ধার কিংবা বাহ্যতঅনুমেয় বিরোধ নিষ্পত্তিজনিত মতপার্থক্য হয়েছে এবং যেসব মাসআলায় রায় ও কিয়াসের বিভিন্নতাজনিত মতপার্থক্য হয়েছে)ইলমুল ফিকহের পরিভাষায় ‘মাসাইলুল ইজতিহাদ’ বা ‘ইজতিহাদী মাসাইল’ বলে। যদিও একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত বিষয়েওইজতিহাদের কিছু প্রয়োজন হয় তবে পরিভাষায় সাধারণত শেষোক্ত দুই প্রকারকেই ‘মাসাইলুল ইজতিহাদ’ বলা হয়। এপ্রকারের মাসআলায় ইমামগণের মাঝে মতভিন্নতা কেন হয়েছে তা উপরোক্ত আলোচনা থেকেই অনুমান করা যায়। এ সম্পর্কিতবিস্তারিত আলোচনা  بيان أسباب اختلاف الفقهاء ‘ফকীহগণের মতভিন্নতার কারণ’ শীর্ষক কিতাবসূমহে পাওয়া যাবে। 
সুন্নাহর বিভিন্নতা সম্বলিত বিষয়ে মতপার্থক্যের ধরন
এ বিষয়ে শুধু শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. (৭২৮ হি.)-এর কিছু কথা উল্লেখ করছি।
১. শায়খ ইবনে তাইমিয়া রাহ.বলেন, এক্ষেত্রে আমাদের নীতিই সর্বাধিক সঠিক যে, ইবাদতের বিষয়ে একাধিক পদ্ধতি যদিগ্রহণযোগ্য বর্ণনায় পাওয়া যায় তবে কোনো পদ্ধতিকেই মাকরূহ বলা যাবে নাবরং সবগুলো শরীয়তসম্মত হবে।যেমন-সালাতুল খাওফের বিভিন্ন পদ্ধতি; তারজীসহ আযান ও তারজীবিহীন আযান; ইকামতের শব্দাবলি একবার করে উচ্চারণকরা বা দুবার করে উচ্চারণ করা; তাশাহহুদের বিভিন্ন প্রকার; নামাযের শুরুতে পড়ার বিভিন্ন দুআ; কুরআন মজীদের বিভিন্নকিরাত; ঈদের নামাযে অতিরিক্ত তাকবীরের বিভিন্ন নিয়ম; জানাযার নামায ও সিজদায়ে সাহুর বিভিন্ন তরীকা; রাববানা লাকালহামদ বা রাববানা ওয়া লাকাল হামদ বলা ইত্যাদি সব বিষয়ে আমরা এটাই বলে থাকি। তবে কখনো কোনো একটি নিয়মমুস্তাহাব হিসেবে বিবেচিত হয় এবং  দলিলের কারণে অপরটির উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রেও অপরটিকে মাকরূহবলা যায় না।-মাজমূউল ফাতাওয়া ২৪/২৪২-২৪৩; আরো দেখুন : আলফাতাওয়াল কুবরা ১/১৪০
এ প্রকার ইখতিলাফ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রাহ. অন্য কিতাবে লেখেন, ইখতিলাফে তানাওউ কয়েক প্রকার : তন্মধ্যে একটিহচ্ছে এমন মতভেদ, যেখানে প্রত্যেক বক্তব্যই সঠিক এবং প্রত্যেক আমলই শরীয়তসম্মত। যেমন ঐ সমস্ত কিরাত (যেগুলো‘সাবআতু আহরুফে’র অন্তর্ভুক্ত। তথাপি মূল বিষয়টি জানার পূর্বে) সাহাবায়ে কেরামের মাঝে (কোনো কোনোটি) নিয়ে বিবাদহয়েছিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে এ নিয়ে ঝগড়া করতে নিষেধ করলেন এবং বললেন,তোমাদের উভয়ের পড়া সঠিক।
‘এমনভিাবে আযান-ইকামতের পদ্ধতি; নামাযের শুরুতে পড়ার দুআ, তাশাহহুদ, সালাতুল খাওফ, জানাযা ও ঈদের নামাযেরতাকবীর সংক্রান্ত ইখতিলাফ, যেখানে সব পদ্ধতিই শরীয়তসম্মত। যদিও কিছু পদ্ধতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
‘অনেক লোককে দেখা যায়, ইকামতের শব্দ একবার বলা-দুইবার বলা বা এ ধরনের বিষয় নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। এটাএকেবারেই হারাম। আর কেউ কেউ এ পর্যায়ে না পৌঁছলেও দেখা যায়, তারা কোনো একটি পদ্ধতির প্রতি অন্যায় পক্ষপাতপোষণ করে এবং অপরটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিংবা মানুষকে তা  গ্রহণ করতে নিষেধ করে। ফলে তারা রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিষেধের আওতায় এসে যায়। (অর্থাৎ তারা ঐ বিবাদে লিপ্ত হল, যা থেকে রাসূল নিষেধকরেছেন। কারণ তিনি বৈধ মতভিন্নতাকে বিবাদের ভিত্তি বানাতে নিষেধ করেছেন।)-ইকতিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম১/১৩২-১৩৩
তিনি আরো বলেন-
وهذا القسم الذي سميناه اختلاف التنوع كل واحد من المختلفين مصيب فيه بلا تردد، لكن الذم واقع على من بغى على الآخر فيه، وقد دل القرآن على حمد كل واحدة من الطائفتين في مثل ذلك إذا لم يحصل بغي.
আর এ প্রকার মতভেদ, যাকে আমরা বলছি-اختلاف التنوع বা আমলের পদ্ধতির বিভিন্নতার ইখতিলাফ কোনোরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াপ্রত্যেকেই সঠিক। কিন্তু এ ধরনের ইখতিলাফের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি অন্যের উপর বাড়াবাড়ি করে সে নিন্দিত। কারণ কুরআন মজীদথেকে বুঝে আসে যে, এ ধরনের ইখতিলাফের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষই প্রশংসনীয়। যদি এক পক্ষ অপর পক্ষের উপর বাড়াবাড়ি নাকরে।’-ইকতিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম ১/১৩৫; আরো দেখুন : মাজমূউল ফাতাওয়া ২৪/২৪৫-২৪৭
মাসাইলুল ইজতিহাদে মতভিন্নতার ধরন  তার শরঈ বিধান
ইজতিহাদী মাসআলায় মতভিন্নতার ধরন সম্পর্কে প্রথমে বর্তমান যুগের প্রায় সব মাযহাবের বড় বড় মনীষী, যাদেরকে সমগ্রইসলামী বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবে ‘রাবেতাতুল আলামিল ইসলামী’র আলমাজমাউল ফিকহী (ফিকহী বোর্ড)- এ এই বিষয়েমতামত প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ করা হয়েছিল তাদের মতামত উল্লেখ করছি।
ঐ মজলিসের সিদ্ধান্তের সারকথা হল, আকীদা ও বিশ্বাসগত বিষয়ে মতভেদ হচ্ছে يجب أن لا يكون  অর্থাৎ তা না হওয়া অপরিহার্য।আর আহকাম ও বিধানের বিষয়ে যে মতভেদ তা لا يمكن أن لا يكون অর্থাৎ তা না হওয়া অসম্ভব।
(মূল প্রবন্ধে দীর্ঘ সিদ্ধান্তটির আরবী পাঠ ও তরজমা উল্লেখিত হয়েছে।)
এই সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  এতে শায়খ ইবনে বায রাহ. (১৪২০ হি.) ও শায়খ আবদুল্লাহ উমর নাসীফ-এর স্বাক্ষরও আছে।ইজতিহাদী বিষয়ে মতভিন্নতার এই পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য যদি প্রত্যেকের স্মরণ থাকে তাহলে এর ভিত্তিতে পরস্পর কলহ-বিবাদেলিপ্ত হওয়ার সুযোগই হবে না।
পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে ইজতিহাদী মাসায়েলের পরিচয় সম্পর্কে এবং তাতে মতপার্থক্য হওয়ার কারণ সম্পর্কে কিছুভুল ধারণার নিরসন প্রয়োজন। পূর্বের আলোচনা থেকে এ বিষয়টি বোঝা গেলেও আরো স্পষ্ট করার জন্য আলাদা শিরোনামে কিছুকথা আরজ করছি।
ইমামগণের মতভিন্নতার বড় কারণ কি হাদীস না জানা কিংবা না মানা?
অনেকে মনে করেন, অধিকাংশ বিষয়ে মতভিন্নতার মৌলিক কারণ হল, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতিপক্ষের হাদীস সম্পর্কে অবহিত নাথাকা বা সহীহ হাদীস পরিত্যাগ করে যুক্তি বা কিয়াসের আশ্রয় গ্রহণ করা। অথচ আইম্মায়ে দ্বীন ও উলামায়ে হকের যেমতভিন্নতা সে সম্পর্কে এ ধারণা মোটেও সঠিক নয়। কেননা তাদের কেউ কিয়াস বা যুক্তিকে হাদীসের উপর প্রাধান্য দেন না।তাদের কোনো কোনো ফতওয়া যদিও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের হাদীসের ব্যাপারে অবগতি না থাকার কারণে প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু এরসংখ্যা নিতান্তই কম।
আহলে হক উলামায়ে কেরামের মধ্যে বিদ্যমান মতভিন্নতার অধিকাংশের মূলেই ইখতিলাফে মাহমুদ বা ইখতিলাফে মাশরূ-এরশরীয়ত স্বীকৃত বাস্তবিক কারণ বিদ্যমান রয়েছে। এজন্য হাদীসের ইমামগণের মধ্যেও বহু বিষয়ে ইখতিলাফ হয়েছে। ইমামআহমদ, ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী, ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিযী, ইবনে খুযাইমা,ইবনে হিববান, দাউদ জাহেরী, ইবনে হাযম জাহেরী তাদের ব্যাপারে হাদীসের বিরোধিতা বা হাদীসের ব্যাপারে অনবগতিরঅভিযোগ কি কেউ করতে পারে?
শুধু তাই নয়, পরবর্তী যুগের এবং বর্তমানের ঐসব আলেমের মধ্যেও ইখতিলাফ হয়েছে, যারা আহলে হাদীস বা সালাফী নামেপরিচিত। এদের ব্যাপারে সকল আহলে হাদীস বা সালাফী বন্ধু একমত যে, এরা সবাই হাদীসবিশারদ এবং হাদীসের অনুসারীছিলেন। তাঁদের মতপার্থক্যের কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি।
প্রথম উদাহরণ
মিসরের প্রসিদ্ধ শায়খ সাইয়েদ সাবেক রাহ. (১৩৩৩-১৪২৫ হি.) ‘ফিকহুস সুন্নাহ’ নামে একটি বেশ বড়, সহজ ও ভালো কিতাবরচনা করেছেন-আল্লাহ তাআলা তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন-যা মাশাআল্লাহ নতুন প্রজন্মের মাঝে খুবই প্রসিদ্ধ ও সমাদৃত।অনেক তরুণ-যুবক এটিকে মুতাওয়ারাছ ফিকহী কিতাবের উত্তম বিকল্প মনে করে বরণ করে নিয়েছে! তাফাক্কুহ ফিদ দ্বীনেরস্বল্পতার কারণে অনেকে এমনও মনে করে যে, ফিকহের কিতাবগুলোতে আছে ইমামদের ফিকহ আর এই কিতাবে আছে হাদীসও সুন্নাহর ফিকহ! অথচ মূল বিষয় এই যে, হাদীস ও সুন্নাহর ফিকহ সেটাও এবং এটাও। পার্থক্য শুধু এই যে, এখানে ফকীহ ওলেখক হলেন শায়খ সাইয়েদ সাবেক আর ওখানে ফকীহ হলেন খায়রুল কুরূন বা তার নিকটতম যুগের মুজতাহিদ ইমাম আরলেখক হলেন পরবর্তী সময়ের কোনো ফকীহ বা আলেম।
যাই হোক, আমি যা বলতে চাই তা হচ্ছে, এ কিতাবের শুরুতে লেখক লেখেন-
أما بعد! فهذا الكتاب "فقه السنة" يتناول مسائل من الفقه الإسلامي مقرونة بأدلتها من صريح الكتاب وصحيح السنة، ومما أجمعت عليه الأمة ...
والكتاب في مجلداته مجتمعة يعطي صورة صحيحة للفقه الإسلامي الذي بعث الله به محمدا صلى الله عليه وسلم، ويفتح للناس باب الفهم عن الله وعن رسوله، ويجمعهم على الكتاب والسنة، ويقضي على الخلاف وبدعة التعصب للمذاهب، كما يقضي على الخرافة القائلة : بأن باب الاجتهاد قدسد.
 উপরোক্ত কথায় যে চিন্তাগত বিচ্ছিন্নতা রয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকু বলছি যে, তাঁর দাবি, এই কিতাবেরমাসআলাগুলো সরাসরি কুরআনের আয়াত, সহীহ সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মাহর দলিলনির্ভর।
এ কিতাবটি যখন বর্তমান যুগের একজন প্রসিদ্ধ আলেম শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ. (১৩৩২-১৪২০ হি.)-এর সামনে এল,যিনি চিন্তা-চেতনায় সাইয়েদ সাবেকের থেকে আলাদা নন, একই ঘরানার। শায়খ আলবানীর কিতাবাদি; বিশেষত ‘ছিফাতুসসালাহ’র ভূমিকা পাঠ করলেই তা বোঝা যাবে। তিনি যখন এই কিতাবটি অধ্যয়ন করলেন তখন এর উপর টীকা লেখারপ্রয়োজন অনুভব করলেন এবং ‘তামামুল মিন্নাহ ফিততালীকি আলা ফিকহিস সুন্নাহ’ নামে তা লিখলেন। পৃষ্ঠাসংখ্যা চার শরওঅধিক। এর পঞ্চম সংস্করণ (১৪২৬ হি.) আমার সংগ্রহে আছে। 
এতে তিনি ফিকহুস সুন্নাহর মাত্র সিয়াম অধ্যায়-পর্যন্ত টীকা লিখেছেন, যা মূল কিতাবের চার ভাগের এক ভাগ। ১ রজব ১৪০৮হিজরীর তথ্য অনুযায়ী তিনি শুধু এটুকুরই টীকা লিখতে পেরেছেন। অবশিষ্ট অংশের টীকা লেখার জন্য দুআ করেছেন।
শায়খ আলবানী রাহ. ‘তামামুল মিন্নাহ’র ভূমিকায় ‘ফিকহুস সুন্নাহ’র ভুল-ত্রুটির প্রকার সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত সূচি উল্লেখকরেছেন, যাতে চৌদ্দটি প্রকার রয়েছে। নিমেণ তার কিছু উল্লেখ করা হল :
১. সাইয়েদ সাবেক অসংখ্য যয়ীফ হাদীস সম্পর্কে নীরব থেকেছেন।
২. অন্যদিকে অনেক ‘ওয়াহী’ (মারাত্মক যয়ীফ) হাদীসকে শক্তিশালী বলেছেন।
৩. কিছু হাদীসকে যয়ীফ বলেছেন, অথচ তা সহীহ।
৪. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের উদ্ধৃতিতে হাদীস উল্লেখ করেছেন অথচ তাতে সে হাদীস নেই।
৫. এমন কিছু হাদীস উল্লেখ করেছেন, যা হাদীসের কোনো কিতাবেই নেই।
৬. যাচাই বাছাই ছাড়া কোনো কিতাবের উদ্ধৃতিতে কোনো হাদীস উল্লেখ করেছেন অথচ খোদ ঐ কিতাবের লেখকই তাতেহাদীসটি সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছেন, যা তার সহীহ হওয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
৭. কখনো কখনো দলিল ছাড়া মাসআলা উল্লেখ করেছেন, কখনো কিয়াসের ভিত্তিতে মাসআলা প্রমাণ করেছেন। অথচ সেবিষয়ে সহীহ হাদীস বিদ্যমান। আবার কখনো সাধারণ দলিল উল্লেখ করেছেন, অথচ সেই মাসআলার সুনির্দিষ্ট দলিল রয়েছে।
৮. কখনো কখনো এমন মত বা সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিয়েছেন, যার প্রমাণ দুর্বল। অথচ বিপরীত মতটির দলিল শক্তিশালী।
৯. সবচেয়ে আপত্তিকর কাজ এই যে, যে কিতাব সুন্নাহ মোতাবেক আমলের প্রতি দাওয়াত দেওয়ার জন্য লেখা হয়েছে তাতেএমন অনেক মাসআলা আছে, যা সহীহ হাদীসের বিপরীত। অথচ ঐ সহীহ হাদীসগুলোর বিরোধী কোনো হাদীসও নেই।
শায়খ আলবানী রাহ.-এর সব আপত্তি সঠিক নাও হতে পারে। তবে তার গবেষণা ও বিশ্লেষণ অনুযায়ী তো ‘ফিকহুস সুন্নাহ’য় এধরনের অনেক ভুল রয়েছে।
তামামুল মিন্নাহ প্রকাশিত হওয়ার পরও শায়খ সাইয়েদ সাবেক রাহ. দীর্ঘ সময় জীবিত ছিলেন। কিন্তু দু’/চারটি স্থান ব্যতীত তিনি‘ফিকহুস সুন্নাহ’য় কোনো পরিবর্তন করেননি। এর দ্বারা বোঝা যায়, তার দৃষ্টিতে শায়খ আলবানী রাহ.-এর এই আপত্তিগুলোসঠিক নয়। কিংবা তা গ্রহণ করা অপরিহার্য নয়।
এই দুই ব্যক্তিত্বের কেউই হানাফী নন। অন্য কোনো মাযহাবেরও অনুসারী নন। তারা ছিলেন (অনুসৃত ফিকহের সাহায্য ছাড়াইসরাসরি) সুন্নাহর অনুসরণ ও হাদীস অনুযায়ী আমলের প্রতি আহবানকারী নিষ্ঠাবান দুই ব্যক্তি। দুজনই ছিলেন হাদীসের আলেমএবং নির্ঘণ্ট ও কম্পিউটার যুগের আলেম। তারা উভয়েই উম্মতের সামনে (তাদের ভাষায়) ‘ফিকহুল মাযাহিব’-এর স্থলে  ‘ফিকহুস সুন্নাহ’ পেশ করতে চেয়েছেন।
প্রশ্ন এই যে, ফিকহি মতভিন্নতার প্রধান কারণ যদি শুধু এই হয় যে, যাদের মাঝে মতভিন্নতা হয়েছে তাদের একজন হয়তোহাদীস জানতেন না কিংবা হাদীস মানতেন না, অন্তত ঐ মাসআলার হাদীসটি তিনি জানতেন না তাহলে এই দুই শায়খের মাঝেএত বড় বড় এবং এত অধিক মাসআলায় মতভেদ কেন হল?   
দ্বিতীয় উদাহরণ
সম্প্রতি ১৪৩০ হি., মোতাবেক ২০০৯ ঈ. সালে ড. সাদ ইবনে আবদুল্লাহ আলবারীকের দুই খন্ডের একটি কিতাব প্রকাশিতহয়েছে, যার নাম
الإيجاز في بعض ما اختلف فيه الألباني وابن عثيمين وابن باز رحمهم الله تعالى
কিতাবটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮ শ’র অধিক।
কিতাবটির নাম থেকেই বোঝা যায়, এই কিতাবে তিনি এমন কিছু মাসআলা উল্লেখ করেছেন, যেসব মাসআলায় এ যুগেরতিনজন সম্মানিত সালাফী আলেম : শায়খ আবদুল আযীয বিন আবদুল্লাহ বিন বায রাহ. (১৩৩০-১৪২০ হি.), শায়খ মুহাম্মাদইবনে সালেহ ইবনে উছাইমীন রাহ. (১৪২১ হি.) ও শায়খ (মুহাম্মাদ ইবনে নূহ) নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ. (১৩৩২-১৪২০হি.)-এর মাঝে মতভেদ হয়েছে।
কিতাবের নাম থেকে এ বিষয়টিও স্পষ্ট যে, তিনজনের মাঝে যেসব মাসআলায় মতপার্থক্য হয়েছে তার সবগুলো লেখক এখানেউল্লেখ করেননি। তাছাড়া তিনি শুধু ‘কিতাবুর রাযাআ’ দুগ্ধপান অধ্যায় পর্যন্ত মাসআলাগুলো এখানে এনেছেন। এরপরও এতে মাসআলার মোট সংখ্যা দঁড়িয়েছে ১৬৬। আকীদা সংক্রান্ত কিছু মাসআলাও এতে রয়েছে, যেগুলো আকীদার মৌলিক নয়, শাখাগত মাসআলা এবং যার কিছু নমুনা উদ্ধৃতিসহ
البشارة والإتحاف بما بين ابن تيمية والألباني في العقيدة من الاختلاف
নামক পুস্তিকায়ও রয়েছে।
জেনে রাখা দরকার যে, ‘আলইজায’ কিতাবে ‘মাসাইলুল ইজতিহাদে’র উভয় প্রকারের মাসআলাই উল্লেখিত হয়েছে। অর্থাৎ কিছু মাসআলা এমন, যার কোনো শরঈ নস নেই অথবা শরঈ নস পাওয়া গেলেও তা থেকে সংশ্লিষ্ট মাসআলার বিধান আহরণ করতে হলে ইজতিহাদ প্রয়োজন।
তৃতীয় উদাহরণ
ড. বকর ইবনে আবদুল্লাহ আবু যায়েদ রিয়ায-এর পুস্তিকা ‘লা-জাদীদা ফী আহকামিস সালাহ’। ইন্টারনেট সংস্করণ (তৃতীয় সংস্করণ) অনুযায়ী এতে তিনি নামাযের এমন আটটি মাসআলা উল্লেখ করেছেন, যে সম্পর্কে কিছু সালাফী আলেমের ফতওয়া বা আমল তার দৃষ্টিতে প্রমাণহীন ও সুন্নাহবিরোধী।
চতুর্থ উদাহরণ
ড. ইউসুফ কারযাবী-হাফিযাহুল্লাহু তাআলা ওয়া রাআহু-এর কিতাব ‘আলহালাল ওয়াল হারাম ফিলইসলাম’-এর সাথে ড. সালেহ ফাওযানের পুস্তিকা ‘আলই’লাম বিনাকদি কিতাবিল হালালি ওয়াল হারাম’ এবং শায়খ আলবানী রাহ.-এর কিতাব‘গায়াতুল মারাম ফী তাখরজি আহাদীসিল হালালি ওয়াল হারাম’ অধ্যয়ন করা যেতে পারে।


হাদীসের শরণাপন্ন হলে কি মতপার্থক্য দূর হয়না বিবাদ? 
কারো কারো ধারণা, সবাই যদি কুরআন ও হাদীসের অনুসরণের ব্যাপারে সম্মত হয়ে যায় তাহলে ইখতিলাফ দূর হয়ে যাবে।ইখতিলাফ শুধু এ জন্যই হয় যে, এক পক্ষ কুরআন-হাদীস অনুসরণ করে, অপর পক্ষ কুরআন-হাদীস অনুসরণ করে না। এপ্রসঙ্গে তারা নিমেণাক্ত আয়াতটিও উল্লেখ করে থাকে-
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
 (তরজমা) যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হও তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের নিকট পেশ কর। যদি তোমরা আল্লাহ ওশেষ দিবসের উপর ঈমান রাখ। এটা উত্তম ও এর পরিণাম সুন্দর।-সূরা নিসা (৫) : ৫৯
অথচ উপরোক্ত আয়াতে এ কথা বলা হয়নি যে, ‘কুরআন-হাদীসের শরণাপন্ন হলে ইখতিলাফ দূর হয়ে যাবে।’ বরং বলা হয়েছে, ‘বিবাদের ক্ষেত্রসমূহে কুরআন-হাদীসের শরণাপন্ন হও।’ এর অর্থ হল তাহলে বিবাদ মিটে যাবে। এরা বিবাদ মিটে যাওয়াকেইখতিলাফ মিটে যাওয়ার সমার্থক ধরে নিয়েছে এবং এখানেই ভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে। কেননা বিবাদ মিটে যাওয়া ওইখতিলাফ মিটে যাওয়া এককথা নয়। অনেক ক্ষেত্রে ইখতিলাফ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বিবাদ মিটে যায়। পক্ষান্তরে অনেক ক্ষেত্রেইখতিলাফ ও বিবাদ দু’টোই মিটে যায়।
  যেমন বিবাদরতদের মাঝে এক পক্ষ জালিম, অপর পক্ষ মাজলূম। এক পক্ষ হকের উপর, অন্য পক্ষ  বাতিলের উপর। তারা যদিকিতাব-সুন্নাহর শরণাপন্ন হয় এবং কুরআন-সুন্নাহর ফয়সালা মেনে নেয় তাহলে বিবাদও দূর হবে, মতভেদও থাকবে না।পক্ষান্তরে  যেখানে শরীয়তের দলীলের ভিত্তিতে একাধিক মত হয়েছে কিংবা সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রে একজন এক সুন্নাহঅন্যজন  অন্য সুন্নাহ অনুসরণ করছে-এ ধরনের ক্ষেত্রে যদি পরস্পর বিবাদ সৃষ্টি হয় এবং উপরোক্ত আয়াতের নির্দেশনা অনুযায়ীতারা কিতাব-সুন্নাহর শরণাপন্ন হয় তাহলে কিতাব-সুন্নাহ তাদেরকে এই নির্দেশনাই দিবে যে, বিবাদ করো না। কারণ তোমরাউভয়ে সঠিক পথে আছ। কারো অধিকার নেই অন্যের উপর আক্রমণ করার। তো এখানে মতপার্থক্য বহাল থাকা সত্ত্বেও বিবাদদূর হবে।
সহীহ বুখারীর ঐ হাদীস কারো অজানা নয়, যাতে হযরত উমর রা. ও হযরত হিশাম ইবনে হাকীম রা.-এর মধ্যকার বিরোধেরকথা বর্ণিত হয়েছে। যা সাময়িক ঝগড়ার রূপ ধারণ করেছিল। মতবিরোধটি হয়েছিল কুরআনের কিরাত নিয়ে। হযরত উমর রা.হযরত হিশাম রা.কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট হাজির করে তার বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন। তখনরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেকের পড়া শুনলেন। এরপর প্রত্যেককেই বললেন-
هكذا أنزلت
অর্থাৎ এভাবে কুরআন নাযিল হয়েছে।-সহীহ বুখারী ৮/৬৩৯-৬৪০ (ফাতহুল বারী)
এ ধরনের আরেকটি ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বলেছেন-
كلاكما محسن، فاقرآ
    তোমাদের দুজনই ঠিক পড়েছ। তাই পড়তে থাক।-সহীহ বুখারী ৮/৭২০ (ফাতহুল বারী)
বনু কুরাইজার ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীর মর্ম বোঝার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের মাঝেমতভেদ হয়েছিল। উভয় দল হাদীসের মর্ম যা বুঝেছেন সে অনুযায়ী আমল করেছেন। এরপর সরাসরি আল্লাহর রাসূলেরশরণাপন্ন হয়েছেন। কিন্তু তিনি কোনো দলকে তিরস্কার করেননি। বিস্তারিত ঘটনা উদ্ধৃতিসহ সামনে আসছে।
 তো দেখুন, প্রথম ঘটনা ছিল কিরাআতের পার্থক্য সংক্রান্ত, যা সুন্নাহর বিভিন্নতার মধ্যে শামিল। এই মতভেদের ক্ষেত্রে যখনআল্লাহর রাসূলের শরণ নেওয়া হল তিনি বিবাদ মিটিয়ে দিলেন, কিন্তু ইখতিলাফ বহাল রাখলেন এবং বললেন, উভয় পদ্ধতিসঠিক।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল রায় ও ইজতিহাদের মতপার্থক্য। এখানে প্রত্যেক পক্ষ হাদীস থেকে যা বুঝেছেন সে অনুযায়ী আমলকরেছেন। এখানে তাদের মাঝে কোনো বিবাদ হয়নি। এরপরও তাঁরা বোধ হয় এজন্যই আল্লাহর রাসূলকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে,তাঁর আদেশের সঠিক অর্থ জানবে না। কিন্তু হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী, আল্লাহর রাসূল তা বলেননি। শুধু এটুকু করেছেন যে,কোনো পক্ষকেই তিরস্কার করেননি। তাহলে এখানে তিনি ইজতিহাদ এবং সঠিক প্রেরণা তথা হাদীস অনুসুরণের প্রেরণা থেকেপ্রকাশিত সিদ্ধান্তকে বহাল রেখেছেন। এই শ্রেণীর মতভেদকে তিনি বাতিল করেননি। তাহলে ইখতিলাফে মাহমূদ বা ইখতিলাফেমাশরূ, যে নামই দেওয়া হোক, কুরআন-সুন্নাহর সামনে উপস্থাপন করা হলে বিলুপ্ত হবে না। কারণ এ তো কুরআন-সুন্নাহরদলিলের ভিত্তিতেই হয়েছে। হ্যাঁ, এসব বিষয়ে কেউ যদি বিবাদে লিপ্ত হয় সে কুরআন-সুন্নাহর শরণাপন্ন হলে বিবাদ থেকে ফিরেআসবে। কারণ কুরআন তাকে বলবে-
وكلا آتينا حكما وعلما
অর্থ : আর তাদের প্রত্যেককে দিয়েছি প্রজ্ঞা ও জ্ঞান।
এবং হাদীস তাকে বলবে-
كلاكما محسن فاقرءا  এবং فما عنف واحدا من الفريقين
হ্যাঁ, ইখতিলাফে মাযমুম বা নিন্দিত মতভেদের ভিত্তি যেহেতু দলিল-প্রমাণের বিরোধিতা অথবা মূর্খতা ও হঠকারিতা কিংবা প্রবৃত্তিও দুর্বল ধারণার অনুসরণ তাই এ ধরনের ইখতিলাফ কুরআন-হাদীসের দিকে প্রত্যাবর্তন ও অনুসরণের দ্বারা মিটে যায়।
পক্ষান্তরে ইখতিলাফে মাহমুদ বা ইখতিলাফে মাশরূ হয়েই থাকে কুরআন ও হাদীসের উপর অটল থাকার কারণে। তাইকুরআন-হাদীসের দিকে প্রত্যাবর্তনের কারণে এ ইখতিলাফ মিটে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। এজন্য এ ধরনের ইখতিলাফসাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন ও আইম্মায়ে দ্বীনের মাঝেও হয়েছে এবং পরবর্তীতে আহলে হাদীস ও সালাফীউলামায়ে কেরামের মাঝেও হয়েছে।
যারা ‘আসবাবে ইখতিলাফে ফুকাহা’ এবং ‘ফিকহে মুকারান’-এর কিতাবসমূহের সঠিক ধারণা রাখেন তাদের নিকট বিষয়টিঅত্যন্ত স্পষ্ট ও বাস্তব সত্য, তবে কিছু কিছু মানুষ নিজের অজ্ঞতার কারণে এ ধরনের ইখতিলাফকে হাদীস মানা বা না মানারইখতিলাফ বলে মানুষকে বিশ্বাস করাতে চায়।
ইজতিহাদী বিষয়  একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত বিষয়ে সুন্নাহর প্রতি আহবানের সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি  
আলহামদুলিল্লাহ এ শিরোনামের বেশ কিছু জরুরি কথা বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন শিরোনামের আলোচনায় এসে গেছে। কিছু কথাসামনের শিরোনামগুলোতেও আসবে। তবে গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতার কারণে কিছু কথা আলাদা শিরোনামেও নিবেদন করছি।
ইখতিলাফুত তানাওউ বা একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত বিষয়ে আহবানের বিধান  
প্রথমে ‘ইখতিলাফুত তানাওউ’ সম্পর্কে আলোচনা করছি। যেহেতু এখানে মতপার্থক্যের ক্ষেত্র এমন বিষয়, যাতে একাধিকসুন্নাহ রয়েছে, তাই এক্ষেত্রে নিমেণাক্ত নীতিমালা অনুসরণ করা কর্তব্য।
১. যেহেতু সুন্নাহ মোতাবিক আমল হওয়াই উদ্দেশ্য তাই যে এলাকায় যে সুন্নাহর উপর আমল হচ্ছে এবং যে মসজিদে যে সুন্নাহরঅনুসরণ হচ্ছে সেখানে তা-ই বহাল থাকতে দেওয়া উচিত। ঐ এলাকায়, ঐ মসজিদে সাধারণ মানুষকে দ্বিতীয় সুন্নাহর দিকেদাওয়াত দেওয়া মোটেই উচিত নয়। এ দাওয়াত খাইরুল কুরূন তথা সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগে ছিল না।  যেসব ক্ষেত্রে সুন্নাহএকটি সেখানে সেই সুন্নাহর বিষয়ে অবহেলা করা হলে সুন্নাহর দিকে দাওয়াত দিতে হবে। তদ্রূপ কেউ সুন্নাহ ছেড়ে বিদআতেলিপ্ত হলে তাকে বাধা দিতে হবে এবং সুন্নাহর দিকে আসার দাওয়াত দিতে হবে। এ দাওয়াত সালাফের যুগে ছিল।
সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রগুলোতে বেশির চেয়ে বেশি এই তো হবে যে, আপনার বা আপনার উস্তাদের গবেষণা অনুযায়ী, কিংবাআপনার প্রিয় মুহাদ্দিস বা প্রিয় ইমামের গবেষণা অনুযায়ী যে সুন্নাহ মোতাবেক আপনি আমল করছেন তা অপর সুন্নাহ থেকেঅগ্রগণ্য বা সুন্নত হওয়ার দিকটি তাতে বেশি স্পষ্ট। তো এটুকু অগ্রগণ্যতা সাধারণ মানুষকে সেদিকে আহবান করার জন্য যথেষ্টনয়। নতুবা একই কথা অন্য পক্ষেরও বলার অবকাশ থাকবে। তো উভয় পক্ষ যখন নিজেদের দিকে আহবান করতে থাকবে তখনফলাফল কী হবে? সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে অস্থিরতা ছড়ানো হবে না কি?
এ শ্রেণীর মতভেদকে তো ইসলাম ও কুফর কিংবা সুন্নাহ ও বিদআর মতো বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার মতভেদ সাব্যস্ত করা যায় না।এখানে অন্য পক্ষের মতামতের দালিলিক ভিত্তি স্বীকার করতে হবে (যদি ইনসাফ ও ন্যায়নিষ্ঠা থাকে)। তাহলে একের দৃষ্টিতে যেপ্রাধান্য ও অগ্রগণ্যতা তা অন্যের উপর কেন আরোপ করা হবে?
২. এ ধরনের বিষয়ে সর্বোচ্চ যা হতে পারে তা এই যে, আলিমগণ নিজেদের মাঝে আলোচনা করতে পারেন এবং পারস্পরিকমতবিনিময় ও চিন্তার আদান-প্রদান হতে পারে। এ জাতীয় বিষয়ে সালাফের ফকীহ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিদের থেকে এটুকুই পাওয়াযায়।
৩. এই বিষয়গুলোকে ‘নাহি আনিল মুনকারে’র আওতায় নিয়ে আসা এবং কোনো একটি পন্থার উপর মুনকার কাজের মতোপ্রতিবাদ করা, সেই পন্থার অনুসারীদের নিন্দা-সমালোচনা করা, তাদেরকে সুন্নাহবিরোধী ও হাদীসবিরোধী আখ্যা দেওয়া সম্পূর্ণনাজায়েয ও সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ।
এই কথাগুলোর দলিল এই-
ক. যেহেতু দুটো পন্থাই নির্ভরযোগ্য হাদীস বা আছার দ্বারা প্রমাণিত তাই কোনো একটি পন্থার উপর যদি ‘আমর বিল মারুফ ওনাহি আনিল মুনকারে’র বিধান প্রয়োগ করা হয় তাহলে দ্বিতীয় পন্থাটিকে, যা শরীয়তের দলিল দ্বারা প্রমাণিত, প্রত্যাখ্যান করাহয়, যা ভুল।
খ. এর দ্বারা ‘ইবতালুস সুন্নাহ বিল হাদীস’ বা ‘ইবতালুস সুন্নাহ বিস সুন্নাহ’ অর্থাৎ হাদীসের দ্বারা সুন্নাহকে বাতিল করা, কিংবাএক সুন্নাহ দ্বারা অন্য সুন্নাহকে বাতিল করা হয়। এ তো ঐ ক্ষেত্রেও বৈধ নয়, যেখানে দলিলসমূহের মাঝে বিরোধ পরিলক্ষিত হয়।ঐ ক্ষেত্রেও তো একটি দলিলকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, অন্য দলিলকে বাতিল করা হয় না। তাহলে যে ক্ষেত্রে বিরোধ নয়, সুন্নাহরবিভিন্নতা, সেক্ষেত্রে কীভাবে তা বৈধ হতে পারে?
গ. আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানায় একটি ঘটনায় যখন তাঁর আদেশের মর্ম বোঝার ক্ষেত্রেসাহাবীদের মাঝে মতপার্থক্য হল, আর তা হল ফরয নামায কাযা করার  মতো কঠিন বিষয়ে, এরপর এ মতপার্থক্য আল্লাহররাসূলের দরবারে পেশ করা হল তখন তিনি কোনো পক্ষকেই কিছু বলেননি। সুন্নাহর বিরোধিতার অভিযোগ তো দূরের কথা।অথচ আদেশটি (হাদীসটি) তাঁরই ছিল। সুতরাং আদেশের উদ্দেশ্যও তাঁর নিশ্চিতভাবেই জানা ছিল। এরপরও কোনো পক্ষকেআদেশ পালনে ব্যর্থ ঘোষণা করেননি। আল্লাহর রাসূল কি উম্মতের জন্য আদর্শ নন? তাহলে উম্মত কীভাবে সুন্নাহর বিভিন্নতারক্ষেত্রে এ ঘোষণা দিয়ে দেয়?
ঘ. উম্মাহর সালাফ-খালাফ তথা আগের পরের মনীষীগণের ইজমা এই যে-‘লা ইনকারা ফী মাসাইলিল ইজতিহাদ’ অর্থাৎ‘ইজতিহাদী বিষয়ে প্রতিবাদ নয়’। তাহলে যেসব ক্ষেত্রে সুন্নাহর বিভিন্নতামূলক মতপার্থক্য সেখানে প্রতিবাদ করা কীভাবে বৈধহয়?
ঙ. আর বিশেষভাবে একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত ক্ষেত্রগুলোতে সাহাবা-যুগ থেকে সালাফের নীতি ও অবস্থান ‘তাওয়াতুর’ তথাউম্মাহর অবিচ্ছিন্ন কর্মধারার মাধ্যমে প্রমাণিত। তাঁরা এ জাতীয় বিষয়ে একে অন্যের প্রতিবাদ করতেন না। আলিমগণ নিজেদেরমাঝে আলোচনা করতেন।
উল্লেখিত দলিল-প্রমাণের আলোকে যে কথাগুলো নিবেদন করা হল বড় বড় আলিম ও মনীষীগণও তা বলেছেন। তাদের কিছুউদ্ধৃতি সামনে আসছে। আপাতত আমি দুটি কিতাবের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
১. রিসালাতুল উলফা বাইনাল মুসলিমীন (শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর কিছু পুস্তিকা ও ফতোয়ার সমষ্টি)।
সংকলনটি হালাবের মাকতাবুল মাতবূআতিল ইসলামিয়া থেকে শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর সম্পাদনায় ও তাঁরটীকা সহকারে প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রচ্ছদে লেখা আছে-
وفيها أمر الإسلام بالتوحد والائتلاف وحظره التنازع والتفرق عند الاختلاف.
অর্থাৎ এ পুস্তিকায় আলোচনা করা হয়েছে যে, ইসলাম তার অনুসারীদেরকে ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকার আদেশ করেএবং মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শিকার হতে নিষেধ করে।
সংকলনটিতে তানাওউয়ে সুন্নাহ বা সুন্নাহর বিভিন্নতা সম্পর্কেও শায়খ ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর একটি পুস্তিকা আছে। তাতেতিনি ইজমা ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, একাধিক সুন্নাহর ক্ষেত্রে যে মতপার্থক্য তাতে উপরোক্ত  কর্মপন্থাই অনুসরণীয়।
তিনি লেখেন, ‘প্রথমত সালাফের ইজমা আছে যে, এ ধরনের একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত ক্ষেত্রগুলোতে হাদীস-সুন্নাহয় বর্ণিতপ্রতিটি পন্থাই জায়েয ও বৈধ। দ্বিতীয়ত এসব বিষয়ের হাদীস ও আছার থেকেও এই প্রশস্ততা প্রমাণিত হয়।’
দ্বিতীয় পুস্তিকাটি শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে জইফুল্লাহ আররুহাইলী লিখিত। হিজাযের ভালো আলিমদের মাঝে তাঁকে গণ্য করাহয়। তিনি ফকীহও এবং মুহাদ্দিসও। তাঁর এই সারগর্ভ ও দলিল সম্বলিত পুস্তিকাটির নাম- دعوة إلى السنة في تطبيق السنة منهجا وأسلوبا
অত্যন্ত দরদের সাথে পুস্তিকাটি লেখা হয়েছে। তাই সেরকম দরদের সাথেই তা পাঠ করা উচিত। আমার সামনে এ পুস্তিকার প্রথমসংস্করণ রয়েছে, যা দারুল কলম বৈরুত থেকে ১৪১০ হিজরীতে প্রকাশিত হয়েছে।
এতে তিনি উলামা-তালাবা ও দায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, ‘আমরা সুন্নাহর অনুসরণ করতে চাই, সুন্নাহর দিকে আহবানকরতে চাই, কিন্তু আমাদের এ কাজও তো সুন্নাহ অনুসারেই হতে হবে। সুন্নাহর অনুসরণ করতে গিয়ে, সুন্নাহর দিকে দাওয়াতদিতে গিয়ে কোনো কাজ যদি সুন্নাহবিরোধী হয়ে যায় তাহলে কেমন হবে?’
পুস্তিকার শুরুতে তেরোটি আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করেছেন এবং তার আলোকে সর্বমোট ২৪টি বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণকরেছেন। এরপর بعض مظاهر المخالفة للسنة ‘সুন্নাহ-বিরোধিতার কিছু দৃষ্টান্ত’ শিরোনামে এমন কিছু সুন্নাহ-বিরোধী কাজ চিহ্নিতকরেছেন, যেগুলো সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করতে গিয়ে এবং সুন্নাহর দিকে দাওয়াত দিতে গিয়ে করা হয়। এরপর বিভিন্নশিরোনামে বিস্তারিত ও দালিলিক আলোচনা করেছেন। দীর্ঘ আলোচনা করেছেন একাধিক সুন্নাহর ক্ষেত্রগুলোতে নিজের কাছেঅগ্রগণ্য পন্থার দিকে দাওয়াত দেওয়ার বিধান সম্পর্কে। এ পুস্তিকাটিও আদ্যোপান্ত পড়ার মতো। আমি শুধু প্রাসঙ্গিক কিছু কথাতুলে দিচ্ছি।
الإشارة إلى خطأ في مفهومنا لمعنى الالتزام بالكتاب والسنة
وخطأ آخر من أخطائنا في هذا العصر، ارتكبناه في سبيل الدعوة إلى السنة وإلى الاحتكام إلى الكتاب والسنة، وهذا الخطأ هو الجمود باسم الاتباع. لا شك في أن الاتباع للكتاب والسنة واجب، وأن الخضوع والتسليم لهما لازم لكل مسلم، ولا خيرة للمسلم أمام حكم الله وحكم رسوله، كما أنه لا يصْلُحُ أن يتقدم بين يدي الله ورسوله بالقول أو التشريع والحكم، هذا أمر لا جدال فيه، ولكن الخطأ والجناية على الكتاب والسنة هما في الحرص على الجمود، وعدم الفقه وسعة البصيرة في فهم الكتاب والسنة في ضوء نصوصهما ومقاصدهما الشرعية.
فترى فينا :
_ من يتسرع إلى القول بالتحريم
_ ومن يميل إلى التشديد في فهم الأحكام
_ من يتجه إلى القول الواحد دائما في المسائل، وإبطال ما عداه.
_ ومن ينظر إلى المستحبات النظر إلى الواجبات.
_ ومن يتوهم أن السنة في كل الأمور ليست إلا شيئا واحدا. فيحجر المرء بهذا واسعا. في حين أن السنة في مسألة ما قد تكون على وجهين. وليست وجها واحدا، أو يكون الأصل في بعض الأمور أن السنة فيه الإطلاق، وليس التقييد والتحديد.
সংক্ষিপ্ত তরজমা
কিতাব-সুন্নাহর অনুসরণের অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের একটি ভুল 
এ যুগের একটি ভুল, যা কিতাব ও সুন্নাহর দিকে দাওয়াত দিতে গিয়ে আমরা করে থাকি তা হচ্ছে ইত্তিবার নামে স্থবিরতা। কিতাবও সুন্নাহ যে অবশ্যঅনুসরণীয় এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর জন্য তো জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাগবে এবং কিতাব ও সুন্নাহসঠিকভাবে বুঝতে হবে। আজ আমাদের ভুল এখানেই যে, আমরা ইত্তিবা ও অনুসরণের নামে জুমুদ ও স্থবিরতার আশ্রয় নিয়েছি।সঠিকভাবে বোঝা ছাড়াই নিজের বুঝের দিকে দাওয়াত দিচ্ছি।
- কারো কারো প্রবণতা এই যে, কোনো কিছুকে হারাম বলার আগে পর্যাপ্ত চিন্তা-ভাবনা করে না।
- কেউ শরীয়তের বিধান বোঝার ক্ষেত্রে কাঠিন্য ও কড়াকড়ির দিককে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
- কেউ ইখতিলাফী মাসায়েলের ক্ষেত্রে সর্বদা একটি মতই স্বীকার করে এবং অন্যসব মত প্রত্যাখ্যান করে।
- কেউ মুস্তাহাব বিষয়ের সাথে ওয়াজিবের মতো আচরণ করে
- কেউ মনে করে, সকল বিষয়ে সুন্নাহ ও পদ্ধতি কেবল একটিই হয়। এভাবে একটি প্রশস্ত ক্ষেত্রকে তারা সংকীর্ণ বানিয়ে ফেলে।অথচ কোনো কোনো বিষয়ে সুন্নাহর দুটি পন্থা থাকে (অর্থাৎ উভয় পন্থা সুন্নাহসম্মত হয়)। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু মূল বিষয়টিসুন্নাহ হয়ে থাকে, বিশেষ কেনো পন্থা নয়। (পৃ. ৫০-৫১)
তিনি আরো বলেছেন-
الإشارة إلى مسلك خاطئ في فهمنا لمسائل الخلاف الفرعية وطريقة دعوتنا إلى الراجح فيها
لقد ابتليت الأمة الإسلامية في هذا العصر بظهور شيء من الروح الجدلية لدى كثير من المسلمين الصالحين مع نزعة إلى الشدة والغِلظة والفظاظة في طريقة الدعوة وفي الحوار الموقف حتى في المسائل الفقهية الخلافية.
وقد ترتب على هذه الطريقة كثير من المفاسد التي لا يقرها الإسلام، ومن ذلك :
_ تفرق الصف الإسلامي على مسائل فرعية، ففي سبيل الحماس لها والأخذ بالصواب فيها نسِيَتْ بعض الأصول في كثير من الأحيان في سبيل التمسك بالصواب في المسائل الخلافية في تلك الفروع!
_ وترتب على ذلك ظهور التعصبات والتحيّزات التي يرافقها الجهل والظلم، بدعوى الحرص على الحق والصواب في تلك الأمور الخلافية من المسائل الفرعية والأساليب والوسائل!!.
_وترتب على ذلك تجرؤ كثير من صغار الطلاب على الاجتهاد والفتيا وآداب العلم و"المشيخة" أو "الزعامة" العلمية أو الدعوية من قِبَل هؤلاء الصغار، الذين لم يأتوا بجديد سوى الخلاف والفُرْقة والابتعاد عن الجادة، وكان يسعهم الحرص على الخير في منهج وسط يبعدهم عن كل هذه الأنواع من الشر!.
_ لقد نَتَجَ عن هذه المسالك الخاطئة في الدعوة وفي طلب العلم والتفقه في الدين والتعامل مع المخالفين تضخيم بعض الأحكام الفرعية والغلوّ في السنن والمستحبات، وذلك أمر لا يقره الدين، لأن السنن والمستحبات هي من الدين وينبغي أن تؤخذ على أنها كذلك، ولا يجوز أن يتجاوز بها قدرها، كما أنه لا يجوز أن تنقص عن قدرها الذي وضعها الله فيه، والدين بين الغالي والجافي والمُفْرِط والمفرّط، ونتج عن هذا الخلل _ كما قلت _ الوقوع فيما نهى الله تعالى عنه من التفرق في الدين والتفرق في الصف، وآيات الله تعالى أعظم شاهد في نهي الله تعالى أشد النهي عن الأمرين كليهما، وكذا سيرة الرسول صلى الله عليه وسلم وسيرة فقهاء هذه الأمة : أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم ومن تبعهم بإحسان من أئمة السلف، فمن تأمل ذلك كله أدرك الحق في هذه المسألة.
وإن المصلِحَ الحق هو ذلك الذي يسعى في الإصلاح من غير أن يرافق إصلاحه إفساد، أو من غير أن يتلبس إصلاحه بإفساد يعْلَمُهُ أو لا يَعْلَمُهُ!.
তার আলোচনার মূল আরবী পাঠ উল্লেখ করা হয়েছে। শাখাগত বিষয়ে নিজের কাছে অগ্রগণ্য মতের দিকে আহবান করার উপরতিনি কঠিন ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন।
তিনি বলেন, এর দ্বারা মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। এ সকল বিষয়ের পিছনে পড়ে উম্মাহর ঐক্য ও সংহতিরবিষয়টি ভুলে যাওয়া হয়েছে; বরং শাখাগত মাসাইলের পিছনে পড়ে কিছু মৌলিক বিষয়ও চিন্তা থেকে অন্তর্হিত হয়েছে।
- এসব বিষয়ে বাহাস-বিতর্কের পন্থা অনুসরণ করে সময়ের অপচয় করা হয়েছে। ঈমানী মহববত খতম করা হয়েছে। শত্রুতা ওবিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছে, যা  কোনো মুসলিম তার মুসলিম ভাইয়ের প্রতি পোষণ করতে পারে না।
- (যে মতপার্থক্য শরীয়তসম্মত ছিল তাতে মতপার্থক্যের নীতি ও বিধান ত্যাগ করে ভুল পন্থা অনুসরণ করার ফলে) মানুষেরমাঝে অন্যায় পক্ষপাত ও দলীয় চেতনা সৃষ্টি হয়েছে, যার অনিবার্য ফল হচ্ছে, মূর্খতা ও অবিচার।
- এই কর্মপদ্ধতির কারণে ছোট ছোট তালিবুল ইলমও নিদ্বির্ধায় ইজতিহাদ ও ফতোয়ার ময়দানে প্রবেশ করেছে, যা বিভেদ ওবিচ্ছিন্নতা ছাড়া নতুন কোনো সুফল দিতে সক্ষম হয়নি।
- এই ভুল কর্মপন্থার কারণে শাখাগত বিষয়গুলোকে বড় বানিয়ে পেশ করা, সুন্নত-মুস্তাহাবের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা এবংএমনসব বিষয় পয়দা হচ্ছে, যা ইসলামে বৈধ নয়। সুন্নত-মুস্তাহাবকে না তার অবস্থান থেকে উপরে তোলা যাবে, না নীচে নামানোযাবে। দ্বীনের মাঝে কোনো প্রকারের প্রান্তিকতাই বৈধ নয়।
কর্মপন্থার ভুলে দ্বীনের বিষয়ে বিভেদ ও উম্মাহর মাঝে বিবাদ সৃষ্টি হয়েছে, যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলার আয়াতসমূহইসাক্ষ্য দেয়, কত কঠিনভাবে তিনি তা নিষেধ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাত, সাহাবায়ে কেরামও তাবেয়ীনের সীরাতও এ বিষয়ে সাক্ষী।
সত্যিকারের সংস্কারক তো তিনিই, যার সংস্কার-কর্মে ধ্বংসের উপাদান থাকে না।-পৃ. ৪৮-৪৯
আমার ধারণা, একাধিক সুন্নাহ বিষয়ে যে মতপার্থক্য সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার জন্য এটুকু আলোচনাই যথেষ্ট ইনশাআল্লাহ।
ইজতিহাদী মাসাইল বা ফূরুয়ী মাসাইলে মতভিন্নতার ক্ষেত্রে সঠিক কর্মপন্থা 
ইজতিহাদী মাসাইল কাকে বলে তা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। এর অপর নাম আলফূরু’ বা ফুরূয়ী মাসাইল। এসকল মাসআলায়দলিলের ধরনই এমন যে, আলিম ও গবেষকদের মাঝে মতপার্থক্য হতে পারে এবং হয়েছে। তাই এই মতপার্থক্য বিলুপ্ত করারচেষ্টা কোনো সমাধান নয়; এতে মতভেদ আরো বাড়বে। এখানে করণীয় হচ্ছে, ইখতিলাফের নীতি ও বিধান কার্যকর করেইখতিলাফকে তার সীমায় আবদ্ধ রাখা; একে কলহ-বিবাদের কারণ হতে না দেওয়া।
আজ মুসলিম উম্মাহর ট্রাজেডি এই যে, শাখাগত বা অপ্রধান বিষয়কে কেন্দ্র করে তারা কলহ-বিবাদে লিপ্ত হচ্ছে এবং নিজেদেরশক্তি খর্ব করছে। যেন কুরআন মজীদের নিষেধ-
ولا تنازعوا فتفشلوا
এর বাস্তব দৃষ্টান্ত। বিষয়টা আরব-আজমের সংবেদনশীল উলামা-মাশাইখকে অস্থির করে রেখেছে। তাঁরা এ বিষয়ে সুস্পষ্টনির্দেশনা দিয়েছেন এবং দিয়ে যাচ্ছেন।
গত শতাব্দীতে আরবের কিছু ব্যক্তি তাকলীদের বিরুদ্ধে এত বলেছেন এবং ফূরূয়ী মাসাইলের ক্ষেত্রে এত কড়াকড়ি করেছেন যে,যুবশ্রেণীর মাঝে দ্বীনের বিষয়ে স্বেচ্ছাচার ও লাগামহীনতার বিস্তার ঘটেছে, যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সেখানের বড়দেরকে রীতিমতো পরিশ্রম করতে হয়েছে। তো এখানেও ঐ তিক্ত অভিজ্ঞতারমুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায় না থেকে আগেভাগেই আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত।
আমি প্রথমে সালাফে সালেহীনের কিছু ঘটনা ও নির্দেশনা উল্লেখ করছি। এরপর ইনশাআল্লাহ বর্তমান যুগের আরব-আজমেরকয়েকজন মুরববী আলিমের নির্দেশনা তুলে ধরব।
১. ইমাম দারিমী রাহ. (১৮১-২৫৫ হি.) তাঁর কিতাবুস সুনানে বর্ণনা করেছেন যে, (তাবেয়ী) হুমাইদ আততবীল (আমীরুলমুমিনীন) উমার ইবনে আবদুল আযীয রাহ.কে বললেন, ‘আপনি যদি সকল মানুষকে এক বিষয়ে (এক মাযহাবে) একত্র করতেনতাহলে ভালো হত।’ তিনি বললেন, ‘তাদের মাঝে মতপার্থক্য না হলে আমি খুশি হতাম না।’ এরপর তিনি ইসলামী শহরেরগভর্ণরদের উদ্দেশে ফরমান পাঠালেন-
ليقض كل قوم بما اجتمع عليه فقهاءهم
প্রত্যেক কওম যেন ঐ সিদ্ধান্ত মোতাবেক ফায়সালা করে, যে বিষয়ে তাদের ফকীহগণ (আলিমগণ) একমত।-সুনানুদ দারিমী,পৃষ্ঠা : ১৩৪
২. ইমাম ইবনে আবী হাতেম ইমাম মালেক থেকে বর্ণনা করেন যে, খলীফা আবু জাফর মানসুর আগ্রহ প্রকাশ করলেন যে, আমিচাই গোটা মুসলিম সাম্রাজ্যে এক ইলমের (অর্থাৎ মুয়াত্তা মালিকের) অনুসরণ হোক। আমি সকল এলাকার কাযী ওসেনাপ্রধানের নিকট এ ব্যাপারে ফরমান জারি করতে চাই।
ইমাম মালেক রাহ. বললেন, ‘জনাব! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ উম্মতের মাঝে ছিলেন। তিনি বিভিন্ন জনপদেসেনাদল প্রেরণ করেছেন, কিন্তু ইসলামের দিগ্বিজয়ের আগেই তাঁর ওফাত হয়ে গেছে। এরপর আবু বকর খলীফা হয়েছেন। তাঁরআমলেও বেশি কিছু রাজ্য বিস্তার হয়নি। এরপর উমর খলীফা হয়েছেন। তাঁর সময়ে প্রচুর শহর ও জনপদ বিজিত হয়েছে। তিনিসেসব বিজিত এলাকায় শিক্ষা-দীক্ষার জন্য সাহাবীগণকে প্রেরণ করেছেন। সেই সময় থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত (প্রত্যেক জনপদেসাহাবীগণের শিক্ষাই) এক প্রজন্ম থেকে অপর প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছেছে।
‘অতএব আপনি যদি তাদেরকে তাদের পরিচিত অবস্থান থেকে অপরিচিত কোনো অবস্থানে ফেরাতে চান তবে তারা একে কুফরীমনে করবে। সুতরাং প্রত্যেক জনপদকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দিন এবং নিজের জন্য এই ইলমকে (মুয়াত্তা মালেক) গ্রহণকরুন।’
আবু জাফর তাঁর কথা মেনে নিলেন।’-তাকদিমাতুল জারহি ওয়াত তাদীল ২৯
ইবনে সা’দের বর্ণনায় ইমাম মালেকের বক্তব্যে উল্লেখ আছে যে-
يا أمير المؤمنين! لا تفعل هذا، فإن الناس قد سبقت إليهم أقاويل، وسمعوا أحاديث، ورووا روايات، وأخذ كل قوم بما سبق إليهم وعملوا.
ইয়া আমীরাল মুমিনীন! এমনটি করবেন না। কেননা, লোকেরা (সাহাবীগণের) বক্তব্য শুনেছে, হাদীস শুনেছে, রেওয়ায়েত বর্ণনাকরেছে এবং প্রত্যেক জনগোষ্ঠী তাই গ্রহণ করেছে, যা তাদের নিকট পৌঁছেছে এবং তদনুযায়ী আমল করেছে।’-আততবাকাত৪৪০
(القسم المتمم)
খতীব বাগদাদীর বর্ণনায় আছে, ইমাম মালেক  বলেন-
يا أمير المؤمنين! إن اختلاف العلماء رحمة من الله تعالى على هذه الأمة، كل يتبع ما صح عنده، وكل على هدى، وكل يريد الله تعالى.
ইয়া আমীরাল মুমিনীন! নিঃসন্দেহে আলেমগণের মতপার্থক্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এ উম্মতের জন্য রহমত। প্রত্যেকে তাইঅনুসরণ করে, যা তার নিকট সহীহ সাব্যস্ত হয়েছে, প্রত্যেকেই হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং প্রত্যেকেই আল্লাহর (সন্তুষ্টি)কামী।’-কাশফুল খাফা, আলআজলূনী ১/৫৭-৫৮; উকূদুল জুমান, আসসালেহী ১১
বিচক্ষণ ব্যক্তিদের জন্য এই দুটি ঘটনায় জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অনেক উপাদান আছে।
বর্তমান যুগের আকাবির  মাশাইখ
মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. (১৩১৪ হি.-১৩৯৬ হি.)
জাওয়াহিরুল ফিকহের প্রথম খন্ডে হযরতের দুটি রিসালা আছে। দুটোই মূলত আলিমদের সমাবেশে দেওয়া বক্তব্য : ১.ওয়াহদাতে উম্মত, ২. ইখতিলাফে উম্মত পর এক নজর আওর মুসলমানোঁ কে লিয়ে রাহে আমল।
দুটো রিসালাই আমাদের পাঠ করা উচিত।
প্রথম পুস্তিকার শেষে হযরত বলেন, দায়িত্বশীল আলিমদের প্রতি ব্যথিত নিবেদন-‘রাজনীতি ও অর্থনীতির অঙ্গনে এবং পদ ওপদবীর প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে যে বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন তার প্রতিকার তো আমাদের সাধ্যে নেই। কিন্তু দ্বীনী ও ধর্মীয় কাজেনিয়োজিত দলগুলোর নীতি ও কর্মপন্থার যে বিরোধ তা বোধ হয় দূর করা সম্ভব। কারণ সবার লক্ষ্য অভিন্ন। আর লক্ষ্য অর্জনেসফলতার জন্য তা অপরিহার্য। যদি আমরা ইসলামের বুনিয়াদী উসূল ও মৌলনীতি সংরক্ষণের এবং নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতারস্রোত মোকাবেলাকে সত্যিকার অর্থে মূল লক্ষ্য মনে করি তাহলে এটিই সেই ঐক্যের বিন্দু, যেখানে এসে মুসলমানদের সকলফের্কা ও সব দল একত্রিত হয়ে কাজ করতে পারে আর তখনই এই স্রোতের বিপরীতে কোনো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ কার্যকর হতেপারে।
কিন্তু বাস্তব অবস্থার দিকে তাকালে বলতে হয়, এই মূল লক্ষ্যটিই আমাদের দৃষ্টি থেকে গায়েব হয়ে গেছে। এ  কারণে আমাদেরসমস্ত সামর্থ্য এবং জ্ঞান ও গবেষণার সমুদয় শক্তি নিজেদের ইখতিলাফি মাসআলায় ব্যয় হচ্ছে। ওগুলোই আমাদের ওয়াজ,জলসা, পত্রিকা ও বই-পুস্তকের আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এমন কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষ এ কথা মনে করতেবাধ্য হচ্ছে যে, ইসলাম ধর্ম কেবল এই দুই-চার জিনিসেরই নাম। আরো আক্ষেপের বিষয় এই যে, ইখতিলাফী মাসআলাসমূহেযেই দিকটি কেউ অবলম্বন করেছে তার বিপরীতটিকে গোমরাহী এবং ইসলামের শত্রুতা আখ্যা দিচ্ছে। ফলে আমাদের যে শক্তিকুফুরি, নাস্তিকতা, ধর্মহীনতা এবং সমাজে বাড়তে থাকা বেহায়াপনার মোকাবেলায় ব্যয় হতে পারত তা এখন পরস্পরকলহ-বিবাদে ব্যয় হচ্ছে। ইসলাম ও ঈমান আমাদেরকে যে ময়দানে লড়াই ও আত্মত্যাগের আহবান জানায় সেই ময়দান শত্রুরআক্রমণের জন্য খালি পড়ে আছে। আমাদের সমাজ অপরাধ ও অন্যায়ে ভরপুর, আমল-আখলাক বরবাদ, চুক্তি ও লেনদেনেধোঁকাবাজি, সুদ, জুয়া, মদ, শূকর, অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা ও অপরাধপ্রবণতা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মিশে গেছে।
প্রশ্ন হল, আম্বিয়া কেরামের উত্তরসূরী এবং দেশ ও ধর্মের প্রহরীদের নিজেদের মধ্যেকার মতপার্থক্যের বেলায় যতটা সংক্ষুব্ধ হতেদেখা যায় তার অর্ধেকও কেন সেসব খোদাদ্রোহীদের বেলায় দেখা যায় না? এবং  পরস্পর চিন্তাগত মতপার্থক্যের বেলায় যেমনঈমানী জোশ প্রকাশ পায় তা ঈমানের এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কেন প্রকাশ পায় না? আমাদের বাকশক্তি এবং লেখনীশক্তি যেমনশৌর্যবীর্যের সাথে নিজেদের ইখতিলাফি মাসআলায় লড়াই করে তার সামান্যতম অংশও কেন ঈমানের মৌলিক বিষয়ের উপরআসা হুমকির মোকাবেলায় ব্যয় হয় না? মুসলমানদেরকে মুরতাদ বানানোর প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আমরা সকলে কেন সিসাঢালাপ্রাচীরের মতো রুখে দাঁড়াই না?  সর্বোপরি আমরা এ বিষয়ে কেন চিন্তা করি না যে, নবী প্রেরণ ও কুরআন নাযিলের ঐ মহানউদ্দেশ্য, যা পৃথিবীতে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে এবং যা পরকে আপন বানিয়ে নিয়েছে, যা আদম সন্তানদেরকে পশুত্ব থেকে মুক্ত করে মানবতার মর্যাদা দিয়েছে এবং যা সমগ্র দুনিয়াকে ইসলামের আশ্রয়কেন্দ্র বানিয়েছে তা কিশুধু এই সব বিষয়ই ছিল, যার ভিতর আমরা লিপ্ত হয়ে আছি। এবং অন্যদেরকে হেদায়েতের পথে আনার তরীকা ওপয়গম্বরসুলভ দাওয়াত দেওয়ার কি এটাই ছিল ভাষা, যা আজ আমরা অবলম্বন করেছি?
এখনো কি সময় হয়নি যে, ঈমানদারদের অন্তরগুলো আল্লাহর স্মরণ ও তার  নাযিলকৃত সত্যের সামনে অবনত হবে ...
শেষ পর্যন্ত তাহলে ঐ সময় কবে আসবে যখন আমরা শাখাগত বিষয়আশয় থেকে কিছুটা অগ্রসর হয়ে ইসলামের মৌলিকনীতিমালার সংরক্ষণ এবং অবক্ষয়প্রাপ্ত সমাজের সংশোধনকে নিজেদের আসল কর্তব্য মনে করব। দেশের মধ্যে খৃস্টবাদ ওকমিউনিজমের সর্বগ্রাসী সয়লাবের খবর নিব। কাদিয়ানীদের হাদীস অস্বীকার ও ধর্ম বিকৃতির জন্য কায়েম করা প্রতিষ্ঠানগুলোকেপয়গম্বরসুলভ দাওয়াত ও এসলাহের মাধ্যমে মোকাবেলা করব।
আর যদি আমরা এগুলো না করি এবং হাশরের ময়দানে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এ প্রশ্নকরেন যে, আমার দ্বীন ও শরীয়তের উপর এই হামলা হচ্ছিল, ইসলামের নামে কুফরি বিস্তার লাভ করছিল, আমার উম্মতকেআমার দুশমনের উম্মত বানানোর ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চলছিল, কুরআন ও সুন্নাহর প্রকাশ্য বিকৃতি ঘটছিল, আল্লাহ ও রাসূলেরপ্রকাশ্য নাফরমানি করা হচ্ছিল তখন তোমরা ইলমের দাবীদারেরা কোথায় ছিলে? তোমরা এর মোকাবেলায় কতটা মেহনত এবংত্যাগ স্বীকার করেছ? কতজন বিপথগামী ব্যক্তিকে পথে এনেছ? তো আমাদের ভেবে দেখা উচিত সেদিন আমাদের উত্তর কী হবে?
কর্মপন্থা
এজন্য জাতির প্রতি সংবেদনশীল এবং ঈমান ও ইসলামের উসূল ও মাকসাদসমূহের প্রতি সচেতন উলামায়ে কেরামের কাছেআমার ব্যথাভরা নিবেদন-মাকসাদের গুরুত্ব ও নাযুকতাকে সামনে রেখে সবার আগে মন থেকে এই অঙ্গীকার করুন যে,নিজেদের ইলমী ও আমলী যোগ্যতা এবং কথা ও কলমের শক্তিকে বেশির থেকে বেশি ঐ ময়দানে নিয়োজিত করবেন, যারসংরক্ষণের জন্য কুরআন ও হাদীস আপনাদের ডাকছে।
১. সম্মানিত ওলামা! এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিন এবং প্রতিজ্ঞা করুন যে, এ কাজের জন্য নিজের বর্তমান ব্যস্ততার মধ্য থেকে বেশিরথেকে বেশি সময় বের করবেন।
২. পরস্পর মতপার্থক্য ও ইজতিহাদী বিরোধকে কেবল নিজেদের দরস এবং লেখালেখি ও ফতওয়া পর্যন্ত সীমিত রাখবেন। আমজলসা, পত্রপত্রিকা, বিজ্ঞপ্তি, পরস্পর বিতর্ক ও ঝগড়া-বিবাদের মাধ্যমে তাকে বড় করবেন না। নবীদের মতো দাওয়াত ওইসলাহের নীতির অধীনে কষ্টদায়ক ভাষা, নিন্দা, উপহাস, আক্রমণ ও বাক্যচালনা থেকে বিরত থাকবেন।
৩. সমাজে ছড়িয়ে পড়া ব্যধিসমূহের প্রতিকারের জন্য হৃদয়গ্রাহী শিরোনামে সেণহ ও আন্তরিকতাপূর্ণ ভাষা ও আঙ্গিকে কাজ শুরুকরুন।
৪. নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতা এবং কুরআন-সুন্নাহর বিকৃতির মোকাবেলার জন্য পয়গম্বরদের দাওয়াতের নীতি অনুসারে প্রজ্ঞাপূর্ণকৌশল, আন্তরিকতাপূর্ণ আলোচনা এবং হৃদয়গ্রাহী দলিল প্রমাণের মাধ্যমে وجادلهم بالتي هي أحسن এর সাথে নিজের মুখের ভাষা ও কলমেরশক্তিকে ওয়াকফ করে দিন।’
এ ধরনের আরেক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘যে দেশকে একদিকে খৃস্টান মিশনারীরা নিজেদের পূর্ণ শক্তি এবং পার্থিব জাকজমকেরসাথে খৃস্টান-রাজ্য বানানোর স্বপ্ন দেখছে আরেকদিকে প্রকাশ্যে আল্লাহর বান্দা এবং তাদের শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে উপহাস করা হচ্ছে,অন্যদিকে কুরআন ও ইসলামের নামে ঐসব কিছু করা হচ্ছে, যাকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই কুরআন ও ইসলামএসেছিল, সে দেশে কেবল শাখাগত মাসাইল এবং তার বিচার-পর্যালোচনা ও প্রচারণার চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে ঐ মৌলিক বিষয়াদিথেকে যারা উদাসীন রয়েছি তাদের প্রতি যদি আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর তরফ থেকে প্রশ্ন করাহয়-তোমাদের দ্বীনের বিষয়ে যখন এই সকল বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল তোমরা তার জন্য কী করেছিলে, তখন আমাদের কী জবাবহবে? আমার বিশ্বাস, কোনো ফের্কা, কোনো জামাত যখন বিভেদ-বিতর্ক থেকে উপরে উঠে এ বিষয়ে চিন্তা করবে তখন তারবর্তমান কাজকর্মের জন্য অনুশোচনা হবে এবং তার তৎপরতার রোখ বদলে যাবে। যার ফলে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ নিশ্চয়ই হ্রাসপ্রাপ্ত হবে।
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ছালিহ আলউছাইমীন (১৪২১ হি.)
তিনি এ বিষয়ে অনেক বলেছেন এবং অনেক লিখেছেন। আমরা এখানে তার কয়েকটি কথা নকল করছি :
ক) ‘‘এ যুগের কিছু কিছু সালাফী, বিরোধীদেরকে গোমরাহ  বলে থাকে, তারা হকপন্থী হলেও। আর কিছু কিছু লোক তো একেবিভিন্ন ‘ইসলামী’ দলের মত একটি দলীয় মতবাদে পরিণত করেছে। এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়, অবশ্যই এর প্রতিবাদ করতেহবে। তাদেরকে বলতে হবে, সালাফে সালেহীনের কর্মপদ্ধতি লক্ষ করুন, ইজতিহাদগত মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে তাদের নীতি কীছিল এবং তাঁরা কেমন উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁদের মাঝে তো অপেক্ষাকৃত বড় বড় বিষয়েও মতভেদ হয়েছে, কোনোকোনো (শাখাগত) আকীদা বিষয়েও মতভেদ হয়েছে : দেখুন, আল্লাহর রাসূল তাঁর রবকে দেখেছেন কিনা-এ বিষয়ে কেউ বললেন,দেখেননি; কেউ বললেন, দেখেছেন। কেয়ামতের দিন আমল কীভাবে ওজন করা হবে-এ বিষয়ে কেউ বলেছেন, আমল ওজন করাহবে। কেউ বলেছেন, আমলনামা ওজন করা হবে; তেমনি ফিকহের মাসাইল- নিকাহ, ফারাইয, ইদ্দত, বুয়ূ  (বেচাকেনা) ইত্যাদিবিষয়েও তাঁদের মাঝে মতভেদ হয়েছে,  কিন্তু তাঁরা তো একে অপরকে গোমরাহ বলেননি।
‘সুতরাং যাদের বিশ্বাস, ‘সালাফী’ একটি সম্প্রদায়, যার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট রয়েছে, অন্যরা সবাই গোমরাহ, প্রকৃত সালাফীআদর্শের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সালাফী মতাদর্শের অর্থ হচ্ছে, আকিদা-বিশ্বাস, আচরণ- উচ্চারণ, মতৈক্য-মতানৈক্যএবং পরস্পর সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির ক্ষেত্রে সালাফে সালেহীনের পথে চলা। যেমনটি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম বলেছেন; প্রীতি, করুণা ও পরস্পরের প্রতি অনুরাগে মুমিনগণ যেন একটি দেহ, যার এক অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটা দেহজ্বর ও নিদ্রাহীনতায় আর্তনাদ করতে থাকে। এটিই হচ্ছে প্রকৃত সালাফী মতাদর্শ।’ [লিকাআতুল বাবিল মাফতূহ, প্রশ্ন : ১৩২২]
খ) শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ছালিহ উছাইমিন রাহ. জামেয়া ইসলামিয়া মদীনা মুনাওয়ারায় ২১/১২/১৪১১ হিজরী তারিখে একটিমুহাযারা (বক্তৃতা) পেশ করেছিলেন। তাতে তিনি বিশেষভাবে বলেছেন-
سب العالم سبب لانتهاك السنة النبوية وسبب لانتهاك العلم الشرعي.
 ‘আলিমকে কটুক্তি করা সুন্নাহর অমর্যাদা ও শরয়ী ইলমের অমর্যাদার কারণ হয়ে থাকে।’
গ. ‘যখন আলিমদের দিক (তাদের মান-মর্যাদা) দুর্বল হয় তখন সাধারণ মানুষের কিতাব ও সুন্নাহর অনুসরণও দুর্বল হয়ে যায়।’
ঘ. ‘যারা আলিমদের অমর্যাদায় লিপ্ত বাস্তবে তারা সুন্নাহর আবরণ ছিন্ন করার কাজে লিপ্ত।’ 
ঙ. ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মন ও মুখকে সুস্থ ও সংযত রাখা।’
চ. ‘আলিম ও দায়ীগণের নিন্দা-সমালোচনাকারী উম্মতকে আলিম ও দায়ীদের প্রতি বিরূপ করে থাকে। উম্মত আলিম ও দায়ীদেরপ্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। তখন দ্বীন-শরীয়তের প্রতিও তাদের আস্থা থাকে না।
‘সমালোচিতদের প্রতি আস্থা নষ্ট হওয়ার পর সমালোচনাকারীদের প্রতিও লোকের আস্থা থাকে না। আর এতে আনন্দিত হয়ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী (ইসলামের দুশমনেরা)’।-আদদাওয়াতু ইলাল জামাআতি ওয়াল ইতিলাফ পৃষ্ঠা : ১০১
নাসির ইবনে আবদুল কারীম আলআকল
তিনি জামিআতুল ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সাউদ আলইসলামিয়া রিয়াদের প্রফেসর। তিনি ‘আলইফতিরাক : মাফহূমুহু,আসবাবুহূ, সুবুলুল বিকায়াতি মিনহু’ নামে একটি সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ পুস্তিকা লিখেছেন। তাতে তিনি এ কথাও বলেছেন যে,জেনে বুঝে সচেতনতার সাথে ইমামগণের অনুসরণ করা হলে একেও তাকলীদ নামে আখ্যায়িত করা হয়! বলা হয়, মাশাইখেরঅনুসরণ হচ্ছে তাকলীদ আর তা নাজায়েয! আমাদের কাছে কিতাব আছে, জ্ঞানের বিভিন্ন মাধ্যম আছে, এখন কেন আলিমদেরকাছে যেতে হবে? এই ভুল চিন্তা খন্ডন করে তিনি বলেন, ইমাম, মাশাইখ ও আলিমগণের অনুসরণ করা ওয়াজিব ...।
‘শরীয়তের দৃষ্টিতে (আহলে ইলমের) ইত্তিবা ও অনুসরণ অপরিহার্য। কারণ আম মুসলিম জনসাধারণ; বরং ইলম চর্চায়নিয়োজিত অনেকেই ইজতিহাদ তথা সঠিক পন্থায় দলীল-প্রমাণ গ্রহণে ও বিশ্লেষণে পারদর্শী নয়। তো এরা কাদের নিকট থেকেইলম হাসিল করবে? এবং কীভাবে ইলম অর্জনের পদ্ধতি, সুন্নাহর নিয়ম এবং সালাফে সালেহীন ও ইমামগণের নীতি সম্পর্কেজ্ঞান লাভ করবে? এ তো আহলে ইলমের অনুসরণ ছাড়া সম্ভব নয়। একে (নিন্দিত ও বর্জনীয়) তাকলীদ বলে না। নতুবাপ্রত্যেকেই নিজের ইমাম হবে এবং যত ব্যক্তি তত দলের উদ্ভব ঘটবে। এটা নিঃসন্দেহে ভুল। সুতরাং সঠিক পন্থায় ইমামদেরঅনুসরণ (নিন্দিত) তাকলীদ নয়। নিন্দিত তাকলীদ হচ্ছে অন্ধ অনুসরণ। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, (তরজমা) ‘যদি না জানতাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর।’
‘উলামা মাশায়েখ ও দ্বীনদার মুবাল্লিগদের থেকে বিমুখ হয়ে শুধু বইপত্রের মাধ্যমে ইলম অর্জনের চেষ্টা করা এবং মনে করা যে,এখন বইপত্র আছে, ক্যাসেট আছে, প্রচারমাধ্যম আছে, ইলম অর্জনের জন্য এগুলোই যথেষ্ট, এটা ইলম অন্বেষণের একটামারাত্মক ভুল পদ্ধতি।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিভেদের আরেকটি কারণ ‘ফিকহুল খিলাফ’ তথা মতপার্থক্যের প্রকার, বিধান ও নীতি সম্পর্কে এবং‘ফিকহুল জামাআতি ওয়াল ইজতিমা’ তথা ঐক্য ও মতৈক্যের নীতি ও বিধান সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধির অভাব। কোনমতপার্থক্য বৈধ, কোন মতপার্থক্য বৈধ নয় অপর পক্ষকে কোন ক্ষেত্রে মাযূর মনে করা হবে, কোন ক্ষেত্রে মনে করা হবে না,তেমনি জামাআ ও ইজতিমার অর্থ কী, বিভেদ-অনৈক্যের ক্ষতি ও অনিষ্ট কী-এসব বিষয় সঠিকভাবে বোঝা উচিত।
আমার সামনে এ কিতাবের ইন্টারনেট সংস্করণ রয়েছে।
শায়খ আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন ছালিহ আলমুতায
তিনি ‘আদদাওয়াতু ইলাল জামাআতি ওয়াল ইতিলাফ ওয়ান নাহয়ু আনিত তাফাররুকি ওয়াল ইখতিলাফ’ নামে একটি ছোটপুস্তিকা লিখেছেন। তাতে ঐক্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা এবং বিদ্বেষ-অনৈক্য পরিহারের আহবান জানিয়েছেন।
 এ কিতাবে শায়খ ড. সালিহ ইবনে ফাওযান আলফাওযানের অভিমতও রয়েছে। পুস্তিকাটিতে অনেক উদ্ধৃতি ও দলিলের সাথেবারবার বলা হয়েছে যে, ফুরূয়ী মাসআলায় মতভেদের পরও আমাদেরকে ঐক্য ও সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। সকল মতভেদকিন্তু বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতাকে অপরিহার্য করে না।  কোনো মতপার্থক্যের বিষয়ে যদি সংশয় হয় যে, তা সহনীয় কি না তাহলে এরসমাধান বড় বড় আলিমরা করবেন।
মাওলানা মুহাম্মাদ তকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম
হযরত তার সফরনামা ‘সফর দর সফর’ এ কিরগিজিস্তানের বিবরণে লেখেন, ‘এখন সেখানকার পরিস্থিতি কতকটা এমন যে,একদিকে সাধারণ মুসলমান সোভিয়েত ইউনিয়নের চলমান মতবাদ ও কৃষ্টি-কালচারে প্রভাবিত হয়ে দ্বীনের প্রাথমিক বিষয়গুলোসম্পর্কেও অজ্ঞ এবং পশ্চিমা সংস্কৃতিতে মেতে ইসলামের বিধিনিষেধ থেকে সম্পূর্ণ উদাসীন; রাস্তাঘাটে চলাচলকারী  নারীদেরপোশাক থেকে বোঝার উপায় নেই যে, ইসলামী জীবনধারার সাথে তাদের ন্যূনতম যোগাযোগ আছে। অপর দিকে ধর্মীয়অভিভাবকদের মাঝে দ্বিতীয় জামাত করা, জুমার সাথে সতর্কতামূলক যোহর আদায় করা আর সালাফী বন্ধুদের উপস্থিতিরসুবাদে ‘আরশে সমাসীন হওয়া’র মত জটিল জটিল মাসআলা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
‘আলোচনার মূল বিষয় ছিল কিরগিজিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বীনী মেহনতকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় এবং এ ক্ষেত্রেউলামায়ে কেরাম ও দ্বীনী ব্যক্তিবর্গের করণীয় কী হওয়া উচিৎ। এ প্রসঙ্গে শ্রোতাদের কাছে সবিনয় নিবেদন করি যে, শাখাগতমাসআলায় ইখতিলাফ থেকে আপনাদের মনোযোগ ফিরিয়ে নিন। আপনারা নজর দিন উম্মাহর মৌলিক ও স্বতঃসিদ্ধ বিষয়গুলোরশিক্ষা ও প্রচার প্রসারে, অধিকাংশ জনসাধারণ যে সম্পর্কে বেখবর ও অজ্ঞ।
‘আলহামদু লিল্লাহ এ সম্মেলন শ্রোতাদের একথার উপর শেষ হয়েছে যে, আল্লাহর রহমতে কিছু ইখতিলাফ তো মিটে গেছে।বাকিগুলোর ব্যাপারে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, এগুলোকে আলোচনার বিষয় বানাব না। বরং এখন আমাদেরসর্বাত্নক চেষ্টা হবে দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলোর দাওয়াত ও তালীমে  মনোযোগ দেওয়া। (পৃ : ১৩৬- ১৩৮)
রাশিয়ার সফরের বিবরণে লেখেন-
‘রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের কিছু তরুণ আরব ভার্সিটি থেকে কম বেশি পড়াশোনা করে এসেছে। তারা কট্টর সালাফী হয়ে দেশেফিরেছে। যেহেতু দাগিস্তানের অধিকাংশ আলিম শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী, তাঁদের মাঝে দীর্ঘকাল থেকে তাসাওউফেরসিলসিলা অব্যাহতভাবে চলে আসছে আর শাফেয়ী মাযহাবের (পরবর্তী কিছু আলিমের মধ্যে কোনো কোনো) বিদআতেরব্যাপারে কিছু ছাড় আছে-এ কারণে ঐসব তরুণ এখানে এসে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-এর তাকলীদ এবংতাসাওউফের বিরুদ্ধে তারা কঠোরভাবে বিরোধিতা শুরু করেছে। কেউ কেউ তো এখানকার প্রবীণ আলেমদের মুশরিক পর্যন্তবলেছে। এর ভিত্তিতে এখানকার মুসলমানদের মাঝে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে।
‘এ প্রেক্ষাপটে আমার আলোচনার মূল বিষয়বস্ত্ত ছিল, কমিউনিজমের আধিপত্য ও নির্যাতন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পররাশিয়ার মুসলমানদের কর্মপদ্ধতি কী হওয়া উচিৎ। এ প্রসঙ্গে আমি বললাম যে, আজ রাশিয়ার মুসলমানদের মাঝে যদি ইসলামও ইসলামী জীবনপদ্ধতির কোন চিহ্ন বাকি থেকে থাকে তা কেবল প্রবীণ উলামায়ে কেরামের মেহনতের ফসল। যারা কমিউনিস্টশাসনের অন্ধকার রাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইলমে দ্বীনের আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন এবং যারা জীবন ও জীবিকার সকলসুযোগ-সুবিধা ও আরাম-আহার ত্যাগ করে ভবিষ্যত প্রজন্মের দ্বীন ও ঈমানের হেফাযত করেছেন। তাই আজকের তরুণসমাজেরকর্তব্য, ঐসকল মহীরূহ উলামায়ে দ্বীনের যথার্থ মূল্যায়ন ও সম্মান করা। পাশাপাশি এটা কখনো ভোলা উচিৎ নয় যে, শাখাগতমাসআলায় ইখতেলাফ সব যুগেই ছিল। এ ইখতিলাফকে কেন্দ্র করে একপক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে কাফের মুশরিক বলেফতোয়া দেওয়া হলে এতে কেবল ইসলামের শত্রুরাই লাভবান হবে। আজ তো রাশিয়ার অবস্থা এই যে, ইসলাম ও ইসলামেরবিধি-বিধান সম্পর্কে দমনপীড়নের কারণে সাধারণ মুসলমানদের কাছে দ্বীনের মৌলিক শিক্ষাই অস্পষ্ট হয়ে গেছে। এ মুহূর্তেতাদের কাছে দ্বীনের মৌলিক জ্ঞান পৌঁছানো অবশ্যকর্তব্য। মুসলমানদের এমন অসহায় পরিস্থিতিতে ‘আরশে সমাসীন হওয়া’, ‘তাকলীদ চলবে, না গাইরে তাকলীদ’-এ জাতীয় মাসআলায় ইখতিলাফ করা হলে দ্বীনের ক্ষতিসাধনে এর চেয়ে বড় কোনোফেতনা আর হতে পারে না। তাই সাধারণ মুসলমানের কর্তব্য এটাই যে, তারা প্রবীণ আলেমদের সাথে জুড়ে থাকবেন। কোনোবিষয়ে সন্দেহ হলে আপোসে সমাধা করে নেবেন। কলহ ও কোন্দলের দিকে যাবেন না।  (পৃ :১৭৯-১৮০)       
আমি নিবেদন করছিলাম যে, বর্তমান সময়ে এটি গোটা মুসলিম জাহানের সমস্যা। এজন্য বিষয়টির সংশোধন অতি প্রয়োজন।আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। তবে এর জন্য শর্ত হচ্ছে ইখলাস ও হিম্মত।
নামাযের পদ্ধতিতে সুন্নাহর বিভিন্নতা বা সুন্নাহ অনুধাবন কেন্দ্রিক মতপার্থক্য
নামায ঐক্যের চিহ্নএকে বিবাদের কারণ বানাবেন না
 (এ শিরোনামের আলোচনা মাসিক আলকাউসারে এবং নবীজীর নামাযের ভূমিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাই এখানে নির্বাচিতকিছু অংশ তুলে দেওয়া হল।)
উম্মতের উপর ফকীহগণের বড় অনুগ্রহ এই যে, তারা শরীয়তের বিধি-বিধানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যেমন করেছেন তেমনি তাসংকলনও করেছেন। বিশেষত ইবাদতের পদ্ধতি ও তার পূর্ণাঙ্গ কাঠামো স্পষ্টভাবে পেশ করেছেন, যা হাদীস, সুন্নাহ ও ‘আমলেমুতাওয়ারাছ’ (যা সুন্নাহর এক গুরুত্বপূর্ণ প্রকার) থেকে গৃহীত। এর বড় সুবিধা এই যে, কেউ মুসলমান হওয়ার পর সংক্ষেপেতাকে নামাযের পদ্ধতি বুঝিয়ে দেওয়া হয় আর সে সঙ্গে সঙ্গে নামায পড়া আরম্ভ করে। শিশুদেরকে শেখানো হয়, সাত বছর বয়সথেকেই তারা নামায পড়তে থাকে। সাধারণ মানুষ, যাদের দলীলসহ বিধান জানার সুযোগ নেই এবং শরীয়তও তাদের উপর এটাফরয করেনি, তাদেরকে শেখানো হয় আর তারা নিশ্চিন্ত মনে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করতে থাকে।
যদি অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহণের পর এবং শিশুকে বালেগ হওয়ার পর বাধ্য করা হত যে, তোমরা নামায আদায়ের পদ্ধতিহাদীসের কিতাব থেকে শেখ, কারো তাকলীদ করবে না, দলীল-প্রমাণের আলোকে সকল বিষয় নিজে পরীক্ষা করে নামায পড়বেতাহলে বছরের পর বছর অতিবাহিত হবে, কিন্তু তার নামায পড়ার সুযোগ হবে না। একই অবস্থা হবে যদি সাধারণ মানুষকে এইআদেশ করা হয়।
খুব ভালো করে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন যে, কুতুবে ছিত্তা (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) ও অন্যান্যপ্রসিদ্ধ হাদীস-গ্রন্থের সংকলক ইমামগণও প্রথমে নামায শিখেছেন ফিকহে ইসলামী থেকেই, এরপর পরিণত হয়ে হাদীসেরকিতাব সংকলন করেছেন। অথচ হাদীসের কিতাব সংকলন করার পর তারা না ফিকহে ইসলামীর উপর কোনো আপত্তিকরেছেন, আর না মানুষকে ফিকহ সম্পর্কে আস্থাহীন করেছেন। বরং তারা নিজেরাও ফকীহগণের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। তবেযেখানে ফুকাহায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ হয়েছে সেখানে তারা নিজেদের বিচার-বিবেচনা মোতাবেক কোনো এক মতকেঅবলম্বন করেছেন এবং অন্য মত সম্পর্কে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন।
মোটকথা, হাদীসের কিতাবসমূহের সংকলক এবং হাদীসশাস্ত্রের ইমামগণের যেমন বড় অবদান উম্মতের প্রতি রয়েছে তেমনিফিকহে ইসলামীর সংকলক ও ফিকহের ইমামগণেরও বড় অবদান রয়েছে। উম্মাহর অপরিহার্য কর্তব্য, কিয়ামত পর্যন্ত উভয়শ্রেণীর মনীষীদের অবদান স্বীকার করা এবং উভয় নেয়ামত : হাদীস ও ফিকহকে সঙ্গে রেখে চলা।
নামাযের পদ্ধতিগত কিছু বিষয়ে খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকেই বিভিন্নতা ছিল। এটা খাইরুল কুরূনেওছিল এবং পরের যুগগুলোতেও ছিল। এর কারণ সম্পর্কেও ইতিপূর্বে কিছু আলোচনা হয়েছে। এই ধরনের  ক্ষেত্রে উম্মতের করণীয়কী তা শরীয়তের দলীলের আলোকে ফিকহে ইসলামীতে বলা হয়েছে। হাদীস মোতাবেক নামায পড়ার জন্য ওই নির্দেশনা অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই।
এ ধরনের বিষয়ে উম্মাহর যে নীতি ‘খাইরুল কুরূন’ তথা সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীন-এর যুগ থেকে অনুসৃত তাসংক্ষেপে এই :
যে অঞ্চলে যে সুন্নাহ প্রচলিত সেখানে তা-ই চলতে দেওয়া উচিত। এর উপর আপত্তি করা ভুল। কেননা আপত্তি ঐ বিষয়ে করাহয়, যা বিদআত বা সুন্নাহর পরিপন্থী। এক সুন্নাহর উপর এজন্য আপত্তি করা যায় না যে, এটা আরেক সুন্নাহর মোতাবেক নয়।
এ প্রসঙ্গে ইসমাঈল শহীদ রাহ.-এর ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। তিনি একবার রুকু ইত্যাদিতে ‘রাফয়ে ইয়াদাইন’ করতে আরম্ভকরেছিলেন। অথচ সে সময় গোটা ভারতবর্ষের সর্বত্র (ক্ষুদ্র কিছু অঞ্চল ব্যতিক্রম ছিল, যেখানে ফিকহে শাফেয়ী অনুযায়ী আমলহত) নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য কোনো স্থানে রাফয়ে ইয়াদাইন না-করার সুন্নতটি প্রচলিত ছিল। শাহ শহীদ রাহ.-এর বক্তব্য ছিল,মৃত সুন্নত জীবিত করার ছওয়াব অনেক বেশি। হাদীস শরীফে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে-
من تمسك بسنتي عند فساد أمتي فله أجر مأة شهيد
‘উম্মতের ফাসাদের মুহূর্তে যে আমার সুন্নাহকে ধারণ করে সে একশত শহীদের মর্যাদা পাবে।’
তখন তাঁর চাচা হযরত মাওলানা আবদুল কাদের দেহলবী রাহ. (শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ.-এর পুত্র, তাফসীরে মূযিহুল কুরআন-এররচয়িতা) তার এই ধারণা সংশোধন করেন। তিনি বলেন, ‘‘মৃত সুন্নাহকে জীবিত করার ফযীলত যে হাদীসে এসেছে সেখানে বলাহয়েছে যে, উম্মাহর ফাসাদের যুগে যে ব্যক্তি সুন্নাহকে ধারণ করে তার জন্য এই ফযীলত। তো কোনো বিষয়ে যদি দু’টো পদ্ধতিথাকে এবং দু’টোই মাসনূন (সুন্নাহভিত্তিক) হয় তাহলে এদের কোনো একটিকেও ‘ফাসাদ’ বলা যায় না। সুন্নাহর বিপরীতে শিরকও বিদআত হল ফাসাদ, দ্বিতীয় সুন্নাহ কখনও ফাসাদ নয়। কেননা, দু’টোই সুন্নাহ। অতএব রাফয়ে ইয়াদাইন না-করাও যখনসুন্নাহ, তো কোথাও এ সুন্নাহ অনুযায়ী আমল হতে থাকলে সেখানে রাফয়ে ইয়াদাইনের সুন্নাহ ‘জীবিত’ করে উপরোক্ত ছওয়াবেরআশা করা ভুল। এটা ওই হাদীসের ভুল প্রয়োগ। কেননা এতে পরোক্ষভাবে দ্বিতীয় সুন্নাহকে ফাসাদ বলা হয়, যা কোনো মতেইসঠিক নয়।’
এই ঘটনাটি আমি বিশদ করে বললাম। মূল ঘটনা মালফূযাতে হাকীমুল উম্মত খ. ১, পৃ.  ৫৪০-৫৪১, মালফুয : ১১১২৬ খ. ৪, পৃ.৫৩৫, মালফুয : ১০৫৬ এবং মাজালিসে হাকীমুল উম্মত পৃ. ৬৭-৬৯ তে উল্লেখিত হয়েছে।
সারকথা, সালাফে সালেহীন বিদআত থেকে দূরে থাকতেন এবং বিদআতের বিরোধিতা করতেন। আর সুন্নাহ অনুযায়ী আমলকরতেন এবং সুন্নাহকে জীবিত করতেন। কিন্তু কখনও তাদের নীতি ‘ইবতালুস সুন্নাহ বিসসুন্নাহ’ বা ‘ইবতালুস সুন্নাহবিলহাদীস’ ছিল না। অর্থাৎ তারা এক সুন্নাহকে অন্য সুন্নাহর মোকাবেলায় দাঁড় করাতেন না। তদ্রূপ ‘সুন্নতে মুতাওয়ারাছা’ দ্বারাপ্রমাণিত আমলের বিপরীতে রেওয়ায়েত পেশ করে তাকে বিলুপ্ত করার চেষ্টা করতেন না। এক সুন্নাহর সমর্থনে অন্য সুন্নাহকেখন্ডন করা  আর একে ‘মুর্দা সুন্নত জিন্দা করা’ বলে অভিহিত করা তাদের নীতি ছিল না। এটা  ভুল নীতি, যা খাইরুল কুরূনেরশত শত বছর পরে জন্মলাভ করেছে।
২. কয়েক বছর আগের ঘটনা। তখনও শায়খ আলবানী মরহুমের কিতাব ‘ছিফাতুস সালাহ’ তার পুরো নাম-
صفة صلاة النبي صلى الله عليه وسلم من التكبير إلى التسليم كأنك تراها
-এর বাংলা তরজমা প্রকাশিত হয়নি, আমার কাছে একজন জেনারেল শিক্ষিত ভাই এসেছিলেন, যাকে বোঝানো হয়েছিল কিংবাতাদের বোঝানোর দ্বারা তিনি বুঝে নিয়েছিলেন যে, এই দেশের অধিকাংশ মুসলমান যে পদ্ধতিতে নামায পড়ে তা হাদীসমোতাবেক হয় না। তিনি আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ‘সুসংবাদ’ দিলেন যে, আলবানী মরহুমের কিতাব বাংলায় অনুদিতহয়েছে! শীঘ্রই তা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে! জিজ্ঞাসা করলেন, এ কিতাব সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা আছে কি না! জানা নেই,তিনি মাসআলা জানার জন্য এসেছিলেন, না ‘হেদায়েত’ করার জন্য। আমি শুধু এটুকু আরজ করেছিলাম যে, আপনি আপনারশিক্ষকদের কাছ থেকে তিন-চার জন  সাহাবীর নাম নিয়ে আসুন যাদের নামায শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলবানী মরহুমের কিতাবেউল্লেখিত নিয়ম অনুযায়ী ছিল! তিনি ওয়াদা করে গিয়েছিলেন, কিন্তু সাত-আট বছর অতিবাহিত হল আজও তাঁর দেখা পাইনি!
একটু চিন্তা করুন। তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া নামাযের অন্য কিছু তাকবীরের মধ্যে রাফয়ে ইয়াদাইন করা যদি আবদুল্লাহ ইবনেউমর রা. ও অন্য কিছু সাহাবীর আমল হয়ে থাকে তাহলে রাফয়ে ইয়াদাইন না-করা তাঁর পিতা খলীফায়ে রাশেদ হযরত উমরইবনুল খাত্তাব রা-এর আমল। তদ্রূপ চতুর্থ খলীফায়ে রাশেদ হযরত আলী ইবনে আবু তালিব রা. ও প্রবীণ সাহাবীদের মধ্যেআবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.সহ সাহাবীদের এক জামাত এই নিয়মেই নামায পড়েছেন। তো এদের মধ্যে কার নামাযকে আপনিখেলাফে সুন্নত বলবেন?
আমাদের যে বন্ধুরা শুধু রাফয়ে ইয়াদাইনকেই সুন্নত মনে করেন এবং রাফয়ে ইয়াদাইন না করাকে ভিত্তিহীন বা খেলাফে সুন্নতমনে করেন তারা ফাতিহা পাঠ সম্পর্কে বলে থাকেন যে, ইমামের পিছনে জোরে ও আস্তে সব কিরাতের নামাযে মুকতাদীর জন্যফাতিহা পড়া ফরয, না পড়লে নামায হবে না। কোনো কোনো কট্টর লোক তো এমনও বলে যে, ফাতিহা ছাড়া যেহেতু নামায হয়না তো যারা ইমামের পিছনে ফাতিহা পড়ে না তারা সব যেন বে-নামাযী। আর বে নামাযী হল কাফির!! (নাউযুবিল্লাহ)
আমাদের এই বন্ধুরা যদি চিন্তা করতেন যে, যে আবদুল্লাহ ইবনে উমরের রা. বর্ণনাকৃত হাদীস মোতাবেক তারা রফয়ে ইয়াদাইনকরে থাকেন তিনিও তো ইমামের পিছনে কুরআন (ফাতিহা এবং ফাতিহার সঙ্গে আরো কিছু অংশ) পড়তেন না। মুয়াত্তায় সহীহসনদে এসেছে, তিনি বলেন-
إذا صلى أحدكم خلف الإمام فحسبه قراءة الإمام، وإذا صلى وحده فليقرأ
‘যখন তোমাদের কেউ ইমামের পিছনে নামায পড়ে তখন ইমামের কিরাতই তার জন্য যথেষ্ট। আর যখন একা পড়ে তখন সেযেন (কুরআন) পড়ে।’
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর বিশিষ্ট শাগরিদ নাফে রাহ. তাঁর এই ইরশাদ বর্ণনা করে বলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে উমর ইমামেরপিছনে পড়তেন না।’ (মুয়াত্তা পৃ. ৮৬)
ওই বন্ধুদের ‘নীতি’ অনুযায়ী তো আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এরও নামায হত না! আর যখন তাঁর নামায হত না তাহলে রাফয়েইয়াদাইন বিষয়ে কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে তাঁর বর্ণনাকৃত হাদীস দ্বারা প্রমাণ দেওয়া যাবে কি? কেননা (তাদের কথা অনুযায়ীআল্লাহ মাফ করুন) ‘বেনামাযীর’ হাদীস কীভাবে গ্রহণ করা যাবে!
অথচ শরীয়তের দলীল দ্বারা ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা প্রমাণিত যে, তাঁর হাদীস অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। তাহলে এটা কি প্রমাণ করেনা যে, এ ধরনের বিষয়ে কারো নিন্দা-সমালোচনা করা কিংবা গোমরাহ ও ফাসেক আখ্যা দেওয়া নাজায়েয ও অবৈধ?
আমীন জোরে বলা হবে না আস্তে-এ নিয়ে আমাদের এই বন্ধুরা ঝগড়া-বিবাদ করে থাকেন। হাদীস ও আছারের গ্রন্থসমূহ তারা যদিসঠিক পন্থায় অধ্যয়ন করতেন তবে জানতে পারতেন যে, সুফিয়ান ছাওরী রাহ., যাঁর রেওয়ায়েতকৃত হাদীসের ভিত্তিতে এরাজোরে আমীন বলে থাকেন স্বয়ং তিনিই আমীন আস্তে বলতেন। (আলমুহাল্লা, ইবনে হায্ম ২/৯৫)
যদি বিষয়টা ‘সুন্নাহর বিভিন্নতা’ না হত কিংবা অন্তত ‘মুজতাহাদ ফীহ’ না হত তাহলে এই প্রশ্ন কি আসত না যে, যে ব্যক্তিনিজের রেওয়ায়েতকৃত হাদীসের উপর নিজেই আমল করে না তার রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণগ্রহণ জায়েয কি না?
এভাবে অন্যান্য বিষয়েও যদি চিন্তা করতে থাকেন তাহলে এইসব ক্ষেত্রে সাহাবা-যুগ থেকে চলে আসা মতভেদ আপনাকেবিচলিত করবে না। আর একে বিবাদ-বিসংবাদের মাধ্যম বানানোর প্রবণতাও দূর হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ।
হাদীস অনুযায়ী আমল করারও নির্ধারিত পন্থা রয়েছে। এই পন্থার বাইরে গেলে তা আর হাদীস অনুসরণ থাকে না, যা শরীয়তেকাম্য। ইত্তেবায়ে সুন্নতেরও মাসনূন পদ্ধতি রয়েছে। ঐ পদ্ধতি পরিহার করে সুন্নতের অনুসরণ করতে গেলে তা একটা অসম্পূর্ণ ওসংশোধনযোগ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
কেউ যদি রাফয়ে ইয়াদাইনের সুন্নত অনুযায়ী আমল করে তবে এতে অসুবিধার কী আছে? শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবেরলোকেরাও তো এই সুন্নত মোতাবেক আমল করে থাকেন। হারামাইনের অধিকাংশ ইমাম হাম্বলী মাযহাবের সাথে যুক্ত। তারাওএই সুন্নতের উপর আমল করে থাকেন। কিন্তু তারা তো রাফয়ে ইয়াদাইন না-করার সুন্নতকে প্রত্যাখ্যান করেন না। যারা এইসুন্নত অনুযায়ী আমল করেন তাদের সঙ্গে বিবাদ-বিসংবাদে লিপ্ত হন না, তাদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জবাজি, লিফলেটবাজি করেন না।তারা অন্যের নামাযকে বাতিল বলা তো দূরের কথা খেলাফে সুন্নতও বলেন না। তারা হাদীস অনুসরণের ক্ষেত্রে নিজেদেরবিদ্যা-বুদ্ধির উপর নির্ভর না করে ‘আহলুয যিকর’ ফিকহের ইমামগণের উপর নির্ভর করেন।
এখানে ঐ ঘটনাটি উল্লেখ করা যায়, যা হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর মালফূযাতে রয়েছে। ঘটনার সারসংক্ষেপ এই যে, একজায়গায় আমীন জোরে বলা নিয়ে হাঙ্গামা হয়ে গেল এবং বিষয়টা মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়াল। ঘটনার তদন্তের জন্য যাকেদায়িত্ব দেওয়া হল তিনি তদন্ত শেষে রিপোর্টে লিখলেন যে, ‘আমীন বিলজাহর’ অর্থাৎ ‘আমীন জোরে বলা’ হাদীস শরীফে আছেএবং মুসলমানদের এক মাযহাবে তা অনুসরণ করা হয়। তদ্রূপ ‘আমীন বিছছির’ অর্থাৎ ‘আস্তে আমীন বলা’ও হাদীস শরীফেআছে আর মুসলমানদের এক মাযহাবে তা অনুসৃত। আরেকটি হল ‘আমীন বিশশার’ অর্থাৎ হাঙ্গামা সৃষ্টির জন্য উচ্চ আওয়াজেআমীন পাঠ। এটা উপরোক্ত দুই বিষয় থেকে ভিন্ন। প্রথম দুই প্রকার অনুমোদিত আর তৃতীয়টা নিষিদ্ধ হওয়া চাই।-মালফূযাতেহাকীমুল উম্মত, খ- : ১, কিসত : ২, পৃষ্ঠা : ২৪০-২৪১; খ- : ২, কিসত : ৫, পৃষ্ঠা : ৫০৬, প্রকাশনা দেওবন্দ
বলাবাহুল্য, আস্তে আমীন বলাকে ভুল বা হাদীস পরিপন্থী আখ্যা দিয়ে একমাত্র নিজেদেরকে সুন্নতের অনুসারী দাবি করে উচ্চস্বরে আমীন পাঠ করা ঐ আমীন বিলজাহর নয়, যা হাদীস শরীফে এসেছে এবং সালাফে সালেহীনের এক জামাত যার অনুসরণকরতেন।
৩. যদি সাধারণ মানুষের কাছে উলামা-মাশায়েখের আমলের বিপরীত কোনো দাওয়াত পৌঁছে তাহলে তাদের জন্য যা করণীয় তাএই যে, তারা পরিষ্কার বলে দিবেন, ভাই, আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের নিজেদের পক্ষে গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সম্ভবনয়, আপনাদের কথা যদি মানতে হয় তাহলে আপনাদের উপরই নির্ভর করে মানতে হবে, সেক্ষেত্রে ওলামা-মাশায়েখের কথারউপর নির্ভর করতে অসুবিধা কী?
আর যদি এ বিষয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতেই হয় তাহলে তারপদ্ধতি এই :
১. কেউ যদি আপনাকে বলে, (উদাহরণস্বরূপ) ভাই, তুমি যে রাফয়ে ইয়াদাইন করছ না-এ তো হাদীস বিরোধী! আপনি আদবেরসঙ্গে বলুন, সব হাদীসের বিরোধী, না রফয়ে ইয়াদাইন না-করারও কোনো হাদীস আছে? তারা বলবে, হ্যাঁ, হাদীস তো কিছু আছে,কিন্তু সব জয়ীফ বা ভিত্তিহীন। আপনি প্রশ্ন করুন, এটা কি আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, না হাদীস বিশারদদের ফয়সালা? এরপরসব হাদীস-বিশারদের ফয়সালা, না তাঁদের কারো কারো? একজন ইমামও কি রফয়ে ইয়াদাইন না-করার হাদীসকে ‘সহীহ’বলেননি? যদি তার মধ্যে সততা থাকে তাহলে বলতে বাধ্য হবে যে, জ্বী, একাধিক ইমাম ঐ হাদীসকেও সহীহ বলেছেন।
আপনি বলুন, আমার জন্য এই যথেষ্ট। যখন সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের একটি জামাত রাফয়ে ইয়াদাইন না-করারহাদীস মোতাবেক আমল করেছেন তো আপনি তার বিশেষ কোনো সনদকে জয়ীফ বললে কী আসে যায়? সাহাবায়ে কেরামেরযুগ থেকে প্রজন্ম পরম্পরায় চলে আসা এবং উম্মাহর উলামা-মাশায়েখের মাঝে স্বীকৃত বিষয়কে শুধু সংশ্লিষ্ট একটি হাদীসেরসনদের দুর্বলতা দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ করা কি মারাত্মক ভুল নয়!
আর সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হল, আপনি তাকে হিকমতের সাথে কোনো বিশেষজ্ঞ আলিমের কাছে নিয়ে যাবেন, যার হাদীস ওসীরাতের কিতাবসমূহের উপর এবং ফিকহে মুদাল্লাল ও ফিকহে মুকারানের কিতাবসমূহের উপর দৃষ্টি রয়েছে। ইনশাআল্লাহসকল ভুল ধারণার অবসান ঘটবে এবং কটুকথা, নিন্দা-সমালোচনার ধারাও বন্ধ হবে।
৪. যারা খতীব বা মুদাররিস-এর দায়িত্বে রয়েছেন কিংবা দ্বীনী বিষয়ে সাধারণ মানুষ যাদের শরণাপন্ন হয় তাদের খিদমতেনিবেদন, যদিও আম মানুষ ও জেনারেল শিক্ষিত মানুষের পক্ষে দলীল ও দলীল দ্বারা দাবী প্রমাণের পদ্ধতি বোঝা কঠিন তবুওতাদেরকে  এই প্রশ্ন না করাই ভালো যে, দলীল জানতে চাওয়ার অধিকার তাদের আছে কি না। বরং রাহমাতান বিইবাদিল্লাহতাদের সঙ্গে কোমল আচরণ করুন এবং অনুগ্রহপূর্বক তাদের কথাবার্তা-যদিও তা উল্টাসিধা হোক না কেন-শুনুন। তারা যদিদলীল জানতে চায় তাহলে অন্তত দু’একটি স্পষ্ট দলীল তাদেরকে জানিয়ে দিন। তবে এর জন্য প্রস্ত্ততির প্রয়োজন আছে।আপনাকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি অধ্যয়ন করতে হবে এবং সকল বিষয়ের সর্বাধিক সহজ ও সবচেয়ে বিশুদ্ধদলীল  সহজভাবে উপস্থাপনের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
সাথে সাথে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে খেয়াল রাখুন যে, এ সকল ইখতিলাফী বিষয়ে অন্যরা যেমন প্রান্তিকতার শিকার আপনি যেনতা না হন। যেমন আপনি বলবেন না রাফয়ে ইয়াদাইন মানসূখ হয়ে গেছে; বরং এমন বলুন, রাফয়ে ইয়াদাইন আছে, কিন্তু রাফয়েইয়াদাইন না করার সুন্নাহ আমাদের ইমামের দৃষ্টিতে অগ্রগণ্য। আপনি অন্যের রফয়ে ইয়াদাইন করা ও জোরে আমীন বলার উপরআপত্তি করবেন না, তেমনি আপনার মুসল্লিদেরকেও তাদের সাথে ঝগড়া করার অনুমতি দিবেন না। নতুবা আপনার ও তাদেরঅবস্থা এক হয়ে যাবে। আপনি তাদেরকে হিকমতের সাথে বোঝান যে, ‘আপনাদের তো এক সুন্নাহ থেকে অন্য সুন্নাহর দিকে বাঅন্য মোবাহ তরীকার দিকে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আর যদি যেতেই হয় তাহলে অন্যকে হাদীসবিরোধী মনে করার কোনোসুযোগ নেই। তেমনি এই চিন্তারও সুযোগ নেই যে, আহা! এতদিন পর হেদায়েত পেলাম! আর অন্যের সাথে কলহ-বিবাদের তো প্রশ্নই আসে না। সেটা যদিকরেন তাহলে নিঃসন্দেহে আপনি সুন্নাহ পরিপন্থী রাস্তায় চলে গেলেন! অথচ যে বিষয়ে তাদের  সাথে বিবাদে অবতীর্ণ হবেনতাতে তারা সুন্নাহর উপর আছেন। তাহলে কী লাভ হল? আপনি এমন একটি সুনণতের সমর্থন করতে গিয়ে, যার বিপরীতটিওসুন্নাহ, এমন পথ অবলম্বন করলেন, যা সর্ববাদীসম্মত সিদ্ধান্ত অনুসারে সুন্নাহ পরিপন্থী!!’ এভাবে খুলে খুলে এবং দলিলের সাথেবোঝান। ভৎর্সনা উচিতও নয়, ফায়েদাও নেই।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

ফুরূয়ী ইখতিলাফের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি  বাড়াবাড়ির কারণ 
সব যামানার আলিমগণ ফুরূয়ী বা শাখাগত মাসাইলের মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে যে ভারসাম্যপূর্ণ কর্মপন্থা নির্দেশ করেছেন বর্তমান মুসলিমসমাজে,বিশেষত এ উপমহাদেশে তা মর্মান্তিকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। সম্প্রীতি, উদারতা ও নম্রতার পরিবর্তে এ ধরনের মতভেদের ক্ষেত্রগুলোতে বাড়াবাড়ি ওকড়াকড়ি করা হচ্ছে। এর কারণ কী? এ বিষয়েও আলিমগণ লিখেছেন। বর্তমান প্রবন্ধে এ বিষয়েও কিছু আলোকপাত করা মুনাসিব মনে হচ্ছে।
বাড়াবাড়ির কারণ অনেক। আমি এখানে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করব ইনশাআল্লাহ।
একমুখী অধ্যয়ন  অসম্পূর্ণ অধ্যয়ন
ইখতিলাফী বিষয়ে যিনি মত প্রকাশ করতে চান, নিজের পথ ও পন্থার দিকে আহবান করতেই চান এবং অন্যের পথ ও পন্থার উপর আপত্তি করতেইচান, তার প্রথম কর্তব্য, বিষয়টি গভীরভাবে অধ্যয়ন করা । এ বিষয়ে পক্ষে বিপক্ষে যা কিছু লেখা হয়েছে তা গভীর মনযোগ ও পূর্ণ ন্যায়নিষ্ঠারসাথে অধ্যয়ন করা। কিন্তু দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে আমরা চরম উদাসীন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের অধ্যয়ন একমুখী। সেও অসম্পূর্ণ ও পরনির্ভরঅধ্যয়ন। অথচ এ অধ্যয়নের ভিত্তিতে আমরা মত প্রকাশ করি সম্পূর্ণ মুহাক্কিক; বরং মুজতাহিদসুলভ ভঙ্গিতে!

কিছু উদাহরণ
১. অতি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে দেওয়া হয় যে, ‘বিতরের নামায তিন রাকাত পড়া ভিত্তিহীন। কিংবা তা কেবল জয়ীফ হাদীসে আছে!’
অথচ একাধিক সহীহ হাদীস, অনেকগুলো আছারে সাহাবা এবং মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের কর্মগত ইজমার দ্বারা তিন রাকাত বিতরেরপদ্ধতি প্রমাণিত।
আরো বলা হয় যে, ‘তিন রাকাত যদি পড়তে হয় তাহলে দ্বিতীয় রাকাতে বসবে না। তিন রাকাত এক জলসায় পড়বে!’
যারা এ ধরনের কথা বলেন তারা যদি বিতরের প্রসঙ্গটি ‘শরহু মাআনিল আছার’ ও ‘শরহু মুশকিলিল আছার’ থেকেও অধ্যয়ন করতেন এবং নসবুররায়ার হাশিয়া ‘বুগয়াতুল আলমায়ী’ ও ‘কাশফুস সিত্র আন মাসআলাতিল বিত্র’ (মাওলানা মুহাম্মাদ আনওয়ার শাহ কাশ্মিরি) পাঠ করতেন, অন্ততমাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানবী রাহ.-এর কিতাব ‘‘ইখতিলাফে উম্মত আওর সিরাতে মুসতাকীম’’ থেকেই পাঠ করতেন তাহলেও তাদের এ ধরনেরকথা বলতে দ্বিধা হত।
যেখানে সহীহ মুসলিমসহ অনেক হাদীসের কিতাবে সহীহ হাদীসে এই সাধারণ মূলনীতি বলা হয়েছে যে, ‘নামাযের প্রতি দুই রাকাতেআত্তাহিয়্যাতুর বৈঠক আছে’ সেখানে দলীল ছাড়া এই ফতোয়া দেওয়ার দুঃসাহস কীভাবে হয়, উপরন্তু হাদীস অনুসরণের নামে?!
‘বিতরের নামাযকে মাগরিবের মত বানিও না’-এই হাদীসের পূর্বাপর না দেখেই কেউ ব্যাখ্যা করেছে, ‘বিতরের নামাযে প্রথম বৈঠক করবে না,করলে সালাম ফেরাও।’ এরপর এ ব্যাখ্যারই তাকলীদ করা হচ্ছে। অথচ এ হাদীসের ব্যাখ্যাও হাদীসের মধ্যেই আছে। তা হচ্ছে বিতরের আগে দু’চার রাকাত নফল নামায অবশ্যই পড়বে। মাগরিবের মত শুধু তিন রাকাত পড়বে না। দেখুন : শরহু মাআনিল আছার ও হাশিয়া নাসবুর রায়া।
দুই জলসা ও এক সালামে তিন রাকাত বিতর সম্পর্কে হাদীস ও আছারের দলিল জানার জন্য মাসিক আলকাউসারের জুমাদাল উলা ’৩১ হি. (মে’১০ ঈ.) সংখ্যা থেকে যিলকদ-যিলহজ্ব ’৩১ হি. (নভেম্বর ’১০ ঈ.) পর্যন্ত সংখ্যাগুলো দেখা যায়।
২. বলা হয়ে থাকে, ‘কুনূতের বিভিন্ন দুআ আছে তবে اللهم إنا نستعينك الخ দুআটি নেই।’
অথচ তা মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক (খন্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ১০৫-১২০); মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা (খন্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৫১৮, খন্ড : ১৫, পৃষ্ঠা :  ৩৪০-৩৪৪);কিয়ামুল লায়ল, মুহাম্মাদ ইবনে নাসর আলমারওয়াযী (পৃষ্ঠা : ২৯৬-৩০২) এবং আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকীসহ (খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ২১০) একাধিকহাদীসের কিতাবে আছে। আদ্দুররুল মানসুরের পরিশিষ্টেও কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া আছে।
৩. বলা হয়ে থাকে, ‘দুআ কুনূতের আগে তাকবীরের দলীল হাদীসের কিতাবে নেই।’
অথচ ‘শরহু মুশকিলিল আছার’ তাহাবীতে (খন্ড : ১১, পৃষ্ঠা : ৩৬৫-৩৭৮) দুইজন বড় সাহাবীর আমল বর্ণিত হয়েছে।
৪. বলা হয়ে থাকে, ‘মেয়েদের নামাযের পদ্ধতিও পুরুষের মতোই। উভয়ের নামাযের পদ্ধতি আলাদা হওয়ার কথা ভিত্তিহীন। এটা শুধু হানাফিদেরমাযহাব।’
অথচ বাস্তবতা এই যে, নারী-পুরুষের নামায আদায়ের পদ্ধতি অভিন্ন হওয়ার বিষয়ে আমাদের জানামতে কোনো দ্ব্যর্থহীন সহীহ হাদীস বা আছারনেই। অথচ কিছু সাহাবী ও অনেক তাবেঈ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে উভয়ের নামাযের পদ্ধতি আলাদা হওয়া প্রমাণিত। একটি মারফূ মুরসাল হাদীসওআছে, যাকে একাধিক আহলে হাদীস আলিম শাওয়াহিদ ও সমর্থক বর্ণনার কারণে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। এ প্রসঙ্গে নবাব সিদ্দিক হাসান খানের‘‘আউনুল বারী’’ও দেখা যেতে পারে (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৫২০, দারুর রশীদ হলব, সুরিয়া; খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১৮৪-১৮৫, দারুন নাওয়াদির, বৈরুত, হাদীস :২৫২)
এরপর তা শুধু হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত নয়, চার মাযহাবের ফকীহগণ এ বিষয়ে একমত। আহলে হাদীস আলেমদেরও অনেকে এই ফতোয়াদিয়েছেন। কেউ কেউ এ বিষয়ে আলাদা পুস্তিকাও  লিখেছেন।
যেমন দেখুন, মাওলানা আবদুল হক হাশেমী মুহাজিরে মক্কী-এর পুস্তিকা-
نصب العمود في تحقيق مسألة تجافي المرأة في الركوع والسجود والقعود
এ বিষয়ে মাসিক আলকাউসারের রবিউস সানী ’২৬ হিজরী (জুন ’০৫ ঈ.) সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধটি নবীজীর নামায(মাকতাবাতুল আশরাফ বাংলাবাজার ঢাকা থেকে প্রকাশিত)-এর পরিশিষ্টেও যুক্ত হয়েছে।
আমি শুধু ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর বক্তব্য উল্লেখ করছি। তিনি বলেছেন-
وقد أدب الله تعالى النساء بالاستتار وأدبهن بذلك رسوله صلى الله عليه وسلم، وأحب للمرأة أن تضم بعضا إلى بعض، وتلصق بطنها بفخذيها وتسجد كأسترما يكون لها، وهكذا أحب لها في الركوع والجلوس وجميع الصلاة أن تكون فيها كأستر ما يكون لها.
আল্লাহ তাআলা মহিলাদেরকে পুরোপুরি আবৃত থাকার শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর রাসূলও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অনুরূপ শিক্ষা দিয়েছেন। তাইআমার নিকট পছন্দনীয় হল, সিজদা অবস্থায় মহিলারা এক অঙ্গের সাথে অপর অঙ্গকে মিলিয়ে রাখবে, পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখবে এবং সিজদাএমনভাবে করবে যাতে সতরের পূর্ণ হেফাযত হয়। অনুরূপ রুকু, বৈঠক ও গোটা নামাযে এমনভাবে থাকবে যাতে সতরের পুরাপুরি হেফাযতহয়।-কিতাবুল উম্ম, শাফেয়ী ১/১৩৮
ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর বক্তব্যটি যেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর বাণীরই ব্যাখ্যা। নারীর নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনিবলেছিলেন- تجتمع وتحتفز খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামায আদায় করবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৭৯৪
৫. বলা হয়ে থাকে, ‘বুকের উপর হাত বাঁধার কথাই সহীহ হাদীসে আছে আর তা বুখারীর হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত।’
অথচ সহীহ বুখারীর কোনো হাদীস দ্বারা তা প্রমাণ হয় না। ইবনে খুযায়মার যে হাদীসে বুকের উপর হাত বাঁধার কথা আছে তাতে মুআম্মাল ইবনেইসমাইল নামক একজন রাবী আছেন, যাকে স্বয়ং ইমাম বুখারী রহ. ‘মুনকারুল হাদীস’ বলেছেন।
পাঠকবৃন্দকে মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহর দুটি প্রবন্ধ পাঠ করার আবেদন করব, যা তিনি এ বিষয়েই লিখেছেন। দুটো প্রবন্ধই মাসিকআলকাউসার যিলহজ্ব ’৩২ হি. (নভেম্বর ’১১ হি.) ও মুহাররম ’৩৩ হি. (ডিসেম্বর ’১১ ঈ.) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
৬. বলা হয়ে থাকে, ‘জোরে আমীন বলার হাদীস সহীহ বুখারীতে আছে।’
অথচ সহীহ বুখারীতে ইমাম বুখারী শিরোনাম দিয়েছেন জাহর বা জোরে আমীনের, কিন্তু তাতে এমন একটি হাদীসও নেই, যাতে জাহরের কথাআছে।
ওখানে যে হাদীসগুলো আছে তাতে আমীন বলার ফযীলত উল্লেখিত হয়েছে এবং এ কথা আছে যে, ইমাম-মুকতাদী উভয়েরই আমীন বলা উচিত।কিন্তু জোরে বলার কথা নেই।
৭. বলা হয়ে থাকে, ‘ইমামের পেছনে মুক্তাদির ফাতিহা পড়া ফরয-এই হাদীস সহীহ বুখারীতে আছে।’
অথচ সহীহ বুখারীতে ইমাম বুখারী এ ধরনের শিরোনাম যদিওবা লিখেছেন, কিন্তু তাতে এমন কোনো হাদীস নেই, যাতে মুক্তাদিকে ফাতিহা পড়ারআদেশ করা হয়েছে।
হাঁ, لا صلاة إلا بفاتحة الكتاب (ফাতিহা ছাড়া কোনো নামায নেই) হাদীসটি আছে, কিন্তু এতে তো মুক্তাদির কথা নেই। এই হাদীসের ব্যাপকতায় মুক্তাদিশামিল কি না-তা একটি ইজতিহাদী বিষয়। ইমাম বুখারী ও কোনো কোনো ইমামের ইজতিহাদ অনুসারে মুক্তাদিও শামিল। আবার অন্য অনেকইমামের মতে অনেক দলিলের ভিত্তিতে মুক্তাদির বিধান আলাদা।
৮. বলা হয়ে থাকে যে, ‘তারাবী আট রাকাত হওয়ার দলীল সহীহ বুখারীতে আছে।’
অথচ সহীহ বুখারীতে আছে ‘সালাতুল লায়ল’ সংক্রান্ত হাদীস। এর ব্যাখ্যা তারাবীর দ্বারা করা ঐসকল বন্ধুর নিজস্ব ইজতিহাদ। তাদের যুক্তি, তারাবীও তাহাজ্জুদ একই নামাযের দুই নাম। এগারো মাসের তাহাজ্জুদ রমযান মাসে তারাবী হয়ে যায়। এই দাবির পক্ষে তাদের কাছে কোনো আয়াত,হাদীস বা আছারে সাহাবা নেই। এটা তাদের একান্ত  নিজস্ব ইজতিহাদ, যা ইমাম বুখারীর ইজতিহাদ থেকেও আলাদা।
ইমাম বুখারী রাহ. প্রথম রাতে তারাবী পড়তেন এবং শেষ রাতে তাহাজ্জুদ। তারাবীর প্রতি রাকাতে বিশ আয়াত পড়তেন এবং পুরা কুরআন খতমকরতেন। এবার হিসাব করে দেখুন তারাবী যদি আট রাকাত করে পড়া হয় তাহলে প্রতি রাকাতে বিশ আয়াত করে পড়ে পুরা রমযানে, তা ত্রিশদিনের হলেও, খতম করা সম্ভব কি না।
৯. যে বিনা ওজরে সময়মত ফরয নামায পড়েনি তার উপর কাযা জরুরি হওয়া স্বীকৃত ও সর্বজনবিদিত। এ বিষয়ে জুমহুর উম্মতের ইজমাওরয়েছে। কিন্তু অনেক বন্ধুকে অতি জোড়ালোভাবে বলতে দেখা যায়, ‘ঐ ব্যক্তির কাযা আদায়ের বিধান নেই।’
আমি মনে করি, এটা হাদীস অনুসরণের নামে শায ও বিচ্ছিন্ন মত এবং দলিলবিহীন; বরং দলিলবিরোধী মতামত প্রচার করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাদের খেদমতে আরজ, তারা যেন এই মাসআলাটি অন্তত ইমাম ইবনে আব্দিল বার (৪৬৩ হি.)-এর আলইসতিযকার কিতাবে (খন্ড ১, পৃষ্ঠা :৩০০-৩০১, باب النوم عن الصلاة) পাঠ করেন। আর আদবের সাথে আরজ করব যে, এ বিষয়ে কি শুধু এ হাদীসটি যথেষ্ট নয়-
اقضوا الله، فالله أحق بالوفاء
আল্লাহকে (তাঁর পাওনা) পরিশোধ কর। কারণ আল্লাহই সর্বাধিক হকদার (তাঁর) পাওনা পরিশোধের।
এবং فدين الله أحق أن يقضى
তাহলে আল্লাহর ঋণ তো পরিশোধের অধিক হকদার।
মাসিক আলকাউসারের উদ্বোধনী সংখ্যায় (মুহাররম ১৪২৬ হি., ফেব্রুয়ারি ’০৫ ঈ.) এ বিষয়ে মাশাআল্লাহ একটি সারগর্ভ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
১০. কেউ তো চরম দুঃসাহস প্রদর্শন করে বলেছেন, ‘বিনা অযুতে কুরআন স্পর্শ করা সম্পূর্ণ জায়েয।’ তাদের দাবি, এটা নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়েকোনো সহীহ হাদীস নেই। অথচ
لا يمس القرآن إلا على طهر
 (পবিত্র হওয়া ছাড়া কুরআন স্পর্শ করবে না)-এই হাদীস শুধু সহীহই নয়, অর্থের দিক থেকে মুতাওয়াতির। আর এ বিষয়ে জুমহুর উম্মতের ইজমাআছে। ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. এ বিষয়েও সংক্ষেপে অতি সারগর্ভ আলোচনা করেছেন। আলইসতিযকারে (খন্ড ৮, পৃষ্ঠা : ৯-১৩, باب الأمر بالوضوء لمن مس القرآن) তাঁর আলোচনাটি দেখে নেওয়া যায়।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমর ইবনে হাযম রা.কে যে পত্র দিয়েছিলেন তাতে অন্য অনেক বিধানের সাথে এই বিধানও ছিলযে, অযুহীন কেউ কুরআন স্পর্শ করবে না। পত্রের এ অংশ মুয়াত্তা মালিকেও রয়েছে। ইবনে আবদিল বার রাহ. এই পত্রখানা সম্পর্কে লেখেন-
وكتاب عمرو بن حزم هذا قد تلقاه العلماء بالقبول والعمل، وهو عندهم أشهر وأظهر من الإسناد الواحد المتصل، وأجمع فقهاء الأمصار الذين تدور عليهم الفتوى وعلى أصحابهم بأن المصحف لا يمسه إلا الطاهر.
অর্থাৎ আলিমগণ আমর ইবনে হাযমের এই পত্র সাদরে বরণ করেছেন এবং এ অনুযায়ী আমল করেছেন। এটি তাঁদের কাছে একটি মুত্তাসিলসনদের চেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ও প্রকাশিত। ইসলামী জনপদসমূহের ফতোয়ার স্তম্ভ যেসব ফকীহ (মুজতাহিদ) ও তাঁদের শীষ্যগণ তাঁরা একমত যে,পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কেউ কুরআনকে স্পর্শ করবে না।-আলইসতিযকার ৮/১০
মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহ এ বিষয়েও মাশাআল্লাহ অতি উত্তম ও প্রামাণিক প্রবন্ধ লিখেছে, যা আলকাউসারের সফর ’২৭ হি. (মার্চ ২০০৬ ঈ.)সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকবৃন্দের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন এই প্রবন্ধগুলো অবশ্যই পাঠ করেন।
১১. কেউ কেউ রুকুর সময় এবং রুকু থেকে ওঠার সময় রাফয়ে ইয়াদাইনের সুন্নতের উপর এত জোর দিয়েছেন যে, এই সুন্নতের সমর্থনে রাফয়েইয়াদাইন না করার (এইসব জায়গায় হাত না তোলার) সুন্নত বাতিল করাকে জরুরি মনে করেছেন। তারা নির্দ্বিধায় বলে দিয়েছেন যে, রাফয়েইয়াদাইন না করার বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস নেই; কোনো সাহাবী থেকেও এর কোনো প্রমাণ নেই। অথচ খলীফায়ে রাশেদ ওমর ইবনুল খাত্তাবরা., খলীফায়ে রাশেদ আলী ইবনে আবী তালিব রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.সহ কয়েকজন সাহাবী থেকে হাত না তোলার সুন্নত প্রমাণিত।অনেক তাবেয়ীর আমলও এটি ছিল।
জনৈক ব্যক্তি ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.-এর সামনে ওয়াইল ইবনে হুজর রা.-এর হাদীস পেশ করেছিল যে, তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লামকে রাফয়ে ইয়াদাইন করতে দেখেছেন। তখন ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেছিলেন, যদি ওয়াইল রা. (যিনি ছিলেন একজন আগন্তুকসাহাবী) একবার রাফয়ে ইয়াদাইন করতে দেখেন তাহলে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. (যিনি ছিলেন সফরে-হযরে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খাদিম এবং ফকীহ সাহাবী) পঞ্চাশ বার রফয়ে ইয়াদাইন না করতে দেখেছেন।
(দেখুন : আলমুয়াত্তা, মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, পৃষ্ঠা : ৯২; কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনা ইমাম মুহাম্মাদ ১/৭৫; শরহু মাআনিল আছারতহাবী ১/১৬১; নসবুর রায়াহ লি আহাদীসিল হিদায়া, জামালুদ্দীন যায়লায়ী ১/৩৯৭)
খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত এবং আছারে সাহাবা শরীয়তের উল্লেখযোগ্য দলিল, বিশেষত নামাযের পদ্ধতির ক্ষেত্রে। উপরন্তু এ বিষয়ে সহীহ বাহাসান সনদে একাধিক মারফূ হাদীস রয়েছে।
মুসনাদে আহমদ ও জামে তিরমিযীতে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর সূত্রে যে মারফূ হাদীসটি আছে তাকে খোদ ইমাম তিরমিযী রাহ. ‘হাসান’বলেছেন। ইবনে হাযম জাহেরী রাহ. ‘সহীহ’ বলেছেন। নিকট অতীতের মশহূর মুহাদ্দিস আহমদ শাকির রাহ. জামে তিরমিযীর হাশিয়ায় লিখেছেন-
هذا الحديث صححه ابن حزم وغيره من الحفاظ وهو حديث صحيح، وما قالوا في تعليله ليس بلعة.
ইবনে হাযম এবং আরো কোনো কোনো হাফিযুল হাদীস এই হাদীসকে ‘সহীহ’ বলেছেন। আর একে ‘মা’লূল’ সাব্যস্ত করার জন্য আপত্তিকারীরা যাকিছু বলেছেন বাস্তবে সেগুলো ইল্লত নয়।-জামে তিরমিযী ২/৪১
১২. ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার নামাযে তাকবীর বিষয়ে এক মাসনূন তরীকা এই যে, অতিরিক্ত তাকবীর বারোটি । দ্বিতীয় মাসনূন তরীকা (যাআমাদের মতে অধিক শক্তিশালী), অতিরিক্ত তাকবীর ছয়টি। প্রথম রাকাতে তাকবীরে তাহরীমার পর তিন তাকবীর, অর্থাৎ তাকবীরে তাহরীমাসহচার তাকবীর। আর দ্বিতীয় রাকাতে কিরাআতের পর তিন তাকবীর, এরপর রুকুর তাকবীর, অর্থাৎ রুকুর তাকবীরসহ চার তাকবীর।
কোনো কোনো বন্ধুকে বলতে শোনা যায়, হাদীসে শুধু বারো তাকবীরের আমল পাওয়া যায়। দ্বিতীয় তরীকা কোনো সহীহ হাদীসে পাওয়া যায় না।কেউ কেউ তো এমনও লিখেছেন যে, ঐ বিষয়ে কোনো হাদীসই নেই।
বুঝতে পারছি না, এ জাতীয় অবাস্তব দাবি সম্পর্কে কী বলা যায়। পাঠকবৃন্দকে শুধু এই অনুরোধ করব, তাঁরা যেন দ্বিতীয় মাসনূন তরীকার দলিল,হাদীস ও আছার জানার জন্য মাসিক আলকাউসার রমযান-শাওয়াল ’২৬ হি. সংখ্যায় (২০০৫-এর ভলিউমে) প্রকাশিত ঈদের নামাযের অতিরিক্ততাকবীর বিষয়ক প্রবন্ধটি মনোযোগের সাথে পাঠ করেন। প্রবন্ধটি মাকতাবাতুল আশরাফ, বাংলাবাজার, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘নবীজীর নামাযে’রপরিশিষ্টেও যুক্ত আছে।
এ ধরনের অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। নমুনা হিসাবে এগুলোই যথেষ্ট। এখানে দেখানো উদ্দেশ্য যে, অনেক বন্ধু এ সকল বিষয় এমনভাবে পেশকরে থাকেন যে, ফিকহে হানাফীর অনুসারীদের কাছে এসব বিষয়ে কোনো দলীল নেই। পক্ষান্তরে  তাদের কাছে আছে প্রচুর সহীহ হাদীস!
তাছাড়া উপরে উল্লেখিত ৯, ১০ ও ৪ নম্বর মাসআলাটি তো শুধু ফিকহে হানাফীর নয়, জুমহূরে উম্মতের ইজমায়ী মাসআলা। অন্যান্যমাসআলাতেও হানাফী ফকীহগণের সাথে অন্য অনেক ফকীহ একমত। আর প্রত্যেক মাসআলায় ফকীহ সাহাবী ও তাবেয়ীগণের হাওয়ালা তোএখনই উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণেই আমি নিবেদন করে থাকি যে, আমার এই বন্ধুরা যদি তাদের অধ্যয়নের পরিধি বিস্তৃত ও গভীর করতেনতাহলে এই বাড়াবাড়ি তাদের মধ্যে থাকত না।
অন্তত এটুকু চিন্তা তো অবশ্যই হতো যে, ওদের কাছেও দলীল আছে; আর আমাদের দলীলগুলোর প্রধান্য ও অগ্রগণ্যতাও এত সুস্পষ্ট নয় যে,একদম মুতাওয়াতির ও অকাট্য বিষয়ের মত এতে ভিন্নমতের কোনো অবকাশই নেই।
আংশিক  অস্বচ্ছ ধারণার উপর পূর্ণ প্রত্যয়
অনেক সময় এমন হয় যে, কোনো কোনো বন্ধুর উসূলে হাদীস ও উসূলে ফিকহের কিছু নীতি ও ধারা সম্পর্কে খুব অগভীর ধরনের জানাশোনাথাকে। নীতিটির স্বরূপ ও তাৎপর্য এবং ভাষ্য ও বিস্তারিত অনুষঙ্গের জ্ঞান থাকে না। উসূলের উপর মুতাকাদ্দিমীনের কিতাবসমূহ গভীর মনোযোগেরসাথে পাঠ করার বিষয়ে সচেতনতা থাকে না। শুধু অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ ধারণার উপর ভিত্তি করে বিপরীত পথ ও পন্থা সম্পর্কে কটুক্তি ওসমালোচনার বিরাট সৌধ নির্মাণ করে ফেলা হয়। এরপর ইলমী আলোচনাতেও তাদের মুখে আম লোকের ভাষা ও যুক্তি প্রকাশিত হতে থাকে।যেমন তাদের এ সকল কথা :
সহীহ বুখারী বা সহীহ মুসলিমে নেই
অনেকের মনে দৃঢ় প্রত্যয় আছে যে, ‘যেসকল হাদীস সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিমে নেই তা হয়তো সহীহ নয় কিংবা সহীহ হলেও এই দুইকিতাবের সহীহ হাদীসের সমপর্যায়ের নয়।’ এ কারণে কোনো বিষয়ে হাদীস পেশ করা হলে  বলে, বুখারীতে দেখান, মুসলিমে দেখান। কিংবা বলে,বুখারী-মুসলিমে এর বিপরীত যে হাদীস আছে তা অধিক সহীহ। সুতরাং ঐ হাদীসের উপর আমল করা উচিত এবং এটা বাদ দেওয়া উচিত!
যাদের উসুলুল ফিকহ ও উসুলুল হাদীসের পোখতা ইলম আছে তারা বোঝেন এটা কেমন স্থূল কথা। কারণ :
. ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম দু’জনই পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে, তাঁরা তাঁদের ‘কিতাবুস সহীহ’তে যে হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন তা সবসহীহ। তবে সকল সহীহ হাদীস তাঁরা তাঁদের কিতাবে বর্ণনা করেননি এবং বর্ণনার ইচ্ছাও করেননি। এ কথাটি উভয় ইমাম থেকে সহীহ সনদেপ্রমাণিত।
ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন-
ما أدخلت في كتابي "الجامع" إلا ماصح، وتركت من الصحاح لحال الطول.
অর্থাৎ আমি আমার কিতাবুল জামি’তে শুধু সহীহ হাদীস এনেছি। তবে গ্রন্থের কলেবর বড় হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় (অনেক) সহীহ হাদীস ত্যাগকরেছি।-আলকামিল, ইবনে আদী ১/ ২২৬; তারীখে বাগদাদ ২/৮-৯
‘‘শুরূতুল আইম্মাতিল খামছা’’য় (পৃ. ১৬০- ১৬৩) ইমাম ইসমাঈলীর সূত্রে ইমাম বুখারীর বক্তব্যের আরবী পাঠ এই-
لم أخرج في هذا الكتاب إلا صحيحا، وما تركت من الصحيح أكثر.
আমি এই কিতাবে শুধু সহীহ হাদীস এনেছি। আর যে সহীহ হাদীস আনিনি তার সংখ্যা বেশি।
খতীব বাগদাদী রাহ. ‘‘তারীখে বাগদাদে’’ (১২/২৭৩ তরজমা : আহমদ ইবনে ঈসা আততুসতরী) এবং হাযেমী ‘‘শুরূতুল আইম্মাতিল খামসা’’য় (পৃ.১৮৫) বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম আবু যুরআ রাযী রহ. (যিনি ইমাম মুসলিম রহ. এর উস্তাদ) একবার সহীহ মুসলিম সম্পর্কে বললেন, এর দ্বারা তোআহলে বিদআর জন্য পথ খুলে দেওয়া হল। তাদের সামনে যখন কোনো হাদীস দ্বারা দলীল দেওয়া হবে তখন তারা বলবে, এ তো কিতাবুস সহীহতেনেই!
তেমনি ইমাম ইবনে ওয়ারা রাহ.ও সরাসরি ইমাম মুসলিম রাহ.কে সম্বোধন করে এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তখন ইমাম মুসলিম রাহ. বলেছেন,আমি এই কিতাব সংকলন করেছি এবং বলেছি, এই হাদীসগুলো সহীহ। আমি তো বলিনি যে, এ কিতাবে যে হাদীস নেই তা জয়ীফ! ....
তখন ইবনে ওয়ারা তার ওজর গ্রহণ করেন এবং তাঁকে হাদীস শুনান।
 এই ঘটনা থেকে যেমন বোঝা যায়, ইমাম মুসলিম রাহ. সকল সহীহ হাদীস সংকলনের ইচ্ছাও করেননি তেমনি এ কথাও বোঝা যায় যে, কোনোসহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীস পেশ করা হলে ‘এ তো সহীহ মুসলিমে নেই’ বলে তা ত্যাগ করা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর তরিকা হতে পারে না।একই কথা সহীহ বুখারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
২. ইমাম আবু বকর ইসমায়িলী রহ. (৩৭১ হি.) ‘আল মাদখাল ইলাল মুসতাখরাজ আলা সহীহিল বুখারী’তে হাম্মাদ ইবনে সালামা থেকে ইমামবুখারীর রেওয়ায়েত না করার প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘বুখারী তো তাঁর মানদন্ডে উত্তীর্ণ অনেক সহীহ হাদীসও বর্ণনা করেননি। তবে তা এ জন্য নয় যে,তাঁর দৃষ্টিতে হাদীসগুলো জয়ীফ কিংবা সেগুলোকে তিনি বাতিল করতে চান। তো হাম্মাদ থেকে রেওয়ায়েত না করার বিষয়টিওএরকমই।’-আননুকাত আলা মুকাদ্দিমাতি ইবনিস সালাহ, বদরুদ্দীন যারকাশী ৩/৩৫৩
৩. ইমাম আবু নুয়াইম আসপাহানী রাহ. (৪৩০ হি.) ‘আলমুসতাখরাজ আলা সহীহি মুসলিম’’-এ একটি হাদীসের মান সম্পর্কে  আলোচনা করতেগিয়ে বলেন-
"فإنهما رحمهما الله قد تركا كثيرا مما هو بشرطهما أولى و إلى طريقتهما أقرب"
অর্থাৎ বুখারী মুসলিম এমন অনেক হাদীস ত্যাগ করেছেন, যেগুলো তাদের সংকলিত হাদীস থেকেও তাঁদের নীতি ও মানদন্ডের অধিকনিকটবর্তী।-আলমুসতাখরাজ ১/৩৬
৪. এটি একটি সহজ ও বাস্তব কথা যে, বুখারী-মুসলিমে বর্ণিত হাদীসসমূহের সমপর্যায়ের হাদীস এবং ঐ দুই কিতাবের মানদন্ডে উত্তীর্ণ সহীহহাদীসের সংখ্যা অনেক। শুধু মুসতাদরাকে হাকিমেই এ পর্যায়ের হাদীস, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী হাজারেরকাছাকাছি।-আননুকাত আলা কিতাবি ইবনিস সালাহ
মুসনাদে আহমদ এখন ৫২ খন্ডে বিস্তারিত তাখরীজসহ প্রকাশিত হয়েছে। টীকায় শায়েখ শুআইব আরনাউত ও তার সহযোগীরা সনদের মানসম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। আমাদের প্রতিষ্ঠানের উচ্চতর হাদীস বিভাগের একজন তালিবে ইলম শুধু প্রথম চৌদ্দ খন্ডের রেওয়ায়েতের হিসাবকরেছেন। দেখা গেছে, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ-এই ছয় কিতাবে নেই এমন হাদীসগুলোর মধ্যে :বুখারী ও মুসলিম উভয়ের শর্ত অনুযায়ী ৪০১টি, শুধু বুখারীর শর্ত অনুযায়ী ৬৪টি, শুধু মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী ২১৫টি হাদীস রয়েছে।
এছাড়া সহীহ লিযাতিহী বা সহীহ লিগায়রিহী হাদীসের সংখ্যা ১০০৮টি ও হাসান লিযাতিহী বা হাসান লিগায়রিহী হাদীস ৬১৫টি। এসব সংখ্যাস্বতন্ত্র-অতিরিক্ত হাদীসসমূহের, অর্থাৎ যেগুলোর কোনো মুতাবি বা শাহেদ তাখরীজের বিবরণ অনুযায়ী ছয় কিতাবে নেই।
ইমাম তহাবী রহ. এর ‘শরহু মুশকিলিল আছার’ও তাখরীজসহ ১৬ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে নমুনা হিসাবে শুধু দুই খন্ডের হাদীস ওআছার দেখা হয়েছে তো বুখারী-মুসলিম উভয়ের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হাদীস পাওয়া গেছে ২২২টি, বুখারী-মুসলিম কোনো একজনের মানদন্ডে উত্তীর্ণহাদীসসংখ্যা ১৪৬টি। এর মধ্যে ৪৬ টি এমন যে, তাখরীজের বিবরণ অনুযায়ী বুখারী-মুসলিমে তার কোনো মুতাবি-শাহিদ (সমর্থক বর্ণনাও) নেই।এ ছাড়া এই দুই খন্ডে সহীহ লিযাতিহী হাদীস ২৬৪ টি, সহীহ লিগায়রিহী ১২১টি, হাসান লিযাতিহী ৯৪টি ও হাসান লিগায়রিহী রয়েছে ১৩টি।
শায়েখ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. ‘সিফাতুস সালাহ’র (নবীজীর নামাযের পদ্ধতি) উপর যে কিতাব লিখেছেন তাতে ছয় কিতাবের বাইরে ৮৬ টিহাদীস রয়েছে এবং সহীহ বুখারী-সহীহ মুসলিমের বাইরে সুনানের কিতাবের হাদীস রয়েছে ১৫৬ টি।
৫. স্বয়ং ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রহ. তাদের অন্যান্য কিতাবে এমন অনেক হাদীসকে সহীহ বলেছেন বা দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন,যেগুলো তাঁদের এই দুই কিতাবে নেই। কারো সন্দেহ হলে ‘জুযউল কিরাআতি খালফাল ইমাম’ এবং ‘জুযউ রাফইল ইয়াদাইন’ ইত্যাদি খুলেদেখতে পারেন। জামে তিরমিযী খুললেও দেখতে পাবেন, ইমাম তিরমিযী রাহ. ইমাম বুখারীর উদ্ধৃতিতে এমন অনেক হাদীসকে সহীহ বলেছেন, যাসহীহ বুখারীতে নেই।
তো এই সকল নিশ্চিত ও চাক্ষুষ প্রমাণ থাকার পরও কোনো নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রহণ করতে শুধু এ কারণে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া যে, তা বুখারী, মুসলিমেনেই, অতি সত্হী ও অগভীর চিন্তা নয় কি?
৬. সপ্তম শতাব্দীতে তৈরিকৃত ‘তাকসীমে সাবয়ী’*-এর কারণে যদি কারো সন্দেহ হয় তাহলে  তাদের জেনে রাখা উচিত, ঐ ‘তাকসীম’কারীগণইলিখেছেন-
أما لو رجح قسم على ما فوقه بأمور أخرى تقتضي الترجيح، فإنه يقدم على ما فوقه، إذ قد يعرض للمفوق ما يجعله فائقا
অর্থাৎ অগ্রগণ্যতার অন্যান্য কারণে কোনো প্রকার যদি তার উপরস্থ প্রকারের চেয়ে অগ্রগামী হয় তাহলে তাকে তার উপরের প্রকারের চেয়েঅগ্রগণ্য করা হবে। কারণ এই বিন্যাসে উল্লেখিত নীচের প্রকারের বর্ণনার সাথে কখনো কখনো এমন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়, যা তাকে উপরের পর্যায়েরবর্ণনার সমকক্ষ বা অগ্রগণ্য করে।
এ কথাটি হাফেয ইবনে হাজার রাহ. (৭৫২ হি.) শরহু নুখবাতুল ফিকারে (পৃ. ৩২ ) পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন। তাঁর শাগরিদ মুহাদ্দিস শামসুদ্দীনসাখাভী রাহ.ও (৯০২ হি.) ‘‘ফাতহুল মুগীছে’’ তা আরো খুলে খুলে বয়ান করেছেন। মুহাদ্দিস বদরুদ্দীন যারকাশী রাহ. (৭৯৪ হি.) ‘‘আন নুকাতআলা মুকাদ্দিমাতি ইবনিস সালাহ’’ তে (খন্ড ১, পৃষ্ঠা : ২৫৬-২৫৭) এবং জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. ‘‘তাদরীবুর রাবী’’তে (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৮৮) পরিষ্কারলিখেছেন যে, সহীহ মুসলিমের তুলনায় সহীহ বুখারী অধিক সহীহ হওয়ার অর্থ সমষ্টিগত বিচারে অধিক সহীহ হওয়া; এই নয় যে, সহীহ বুখারীরপ্রতিটি হাদীস সহীহ মুসলিমের প্রতিটি হাদীসের চেয়ে অধিক সহীহ। যারকাশী রাহ. আরো লিখেছেন, অগ্রগণ্যতার কারণ-বিচারে মুহাদ্দিসগণকখনো কখনো মুসলিমের হাদীসকে বুখারীর হাদীসের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
সুতরাং তাঁদের কাছেও ‘তাকসীমে সাবয়ী’ সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য অটল নীতি নয়।
অধিকতর সহীহ বর্ণনাই কি অগ্রগণ্য?
অনেকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ‘যে হাদীস সনদের বিচারে বেশি সহীহ তা-ই শ্রেষ্ঠ ও অগ্রগণ্য, বিপরীত হাদীসটি সহীহ হলেও।’
অথচ এটা নিয়ম নয় যে, হাদীসের মাঝে বাহ্যত বিরোধ দেখা দিলে অন্য কোনো বিবেচনা ছাড়াই অধিক সহীহ হাদীসটি গ্রহণ করা হবে এবংবিপরীতটি বর্জন করা হবে। বরং স্বীকৃত নিয়ম এই যে, এই বিরোধের ক্ষেত্রে জমা, তারজীহ ও নাসখ তথা সমন্বয় সাধন, অগ্রগণ্য বিচার ওনাসিখ-মানসূখ নির্ণয়ের নিয়ম কার্যকর করতে হবে। তারজীহ বা অগ্রগণ্য বিচারের প্রসঙ্গ যদি আসে তাহলে ‘উজূহুত তারজীহ’ বা অগ্রগণ্যতারকারণসমূহের ভিত্তিতে যে হাদীস রাজিহ বা অগ্রগণ্য হবে সে হাদীসের উপরই আমল হবে। অগ্রগণ্যতার অনেক কারণ আছে।** সনদের বিচারেঅধিক সহীহ হওয়া একটিমাত্র কারণ। তো অগ্রগণ্যতার অন্য সকল কারণ ত্যাগ করে শুধু এক কারণের ভিত্তিতে সব জায়গায় সমাধান দিয়েযাওয়া নিয়ম পরিপন্থী।
স্বয়ং ইমাম বুখারী রাহ. কিতাবুস সালাহ-এর দ্বাদশ অধ্যায়ে باب ما يذكر في الفخذ উরূ সতরের অন্তর্ভুক্ত কি না-এ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
সেখানে তিনি বলেছেন-
وحديث أنس أسند وحديث جرهد أحوط، حتى يخرج من اختلافهم
অর্থাৎ আনাস রা.-এর হাদীস, (যার দ্বারা উরূ সতর না হওয়া প্রমাণ হয়) সনদের বিচারে অধিক সহীহ হলেও জারহাদের হাদীস (যাতে উরূ সতরহওয়ার কথা আছে) সতর্কতার বিচারে অগ্রগণ্য। যাতে ইখতিলাফের  মধ্যে থাকতে না হয়।
ফাতহুল বারীতে (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৫৭১) আছে, ইমাম বুখারী রাহ. ‘আততারীখুল কাবীরে’ জারহাদের হাদীসকে ইযতিরাবের কারণে জয়ীফ বলেছেন।তাহলে দেখুন, সহীহর বিপরীতে যয়ীফের উপর আমল করাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। কারণ এটাই সতর্কতার দাবি। যে মাযহাবে উরূ সতর সেই মাযহাবঅনুসারেও যেন গুনাহগার হওয়ার আশঙ্কা না থাকে।
এ কারণে অগ্রগণ্যতার একটিমাত্র কারণকে সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্যের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা এবং সনদের বিচারে যেটি শ্রেষ্ঠ সেটিকেই চূড়ান্তভাবেশ্রেষ্ঠ মনে করা আর  তা-ও বিনা তাহকীকে, শুধু এ কারণে যে, বিপরীত হাদীসটি বুখারী-মুসলিমে নেই-এই চিন্তা মোটেও সঠিক নয়। সুতরাংঅগ্রগণ্যতার অন্যান্য দিক ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং বিবেচনায় রাখা জরুরি। যেমনটা আমরা স্বয়ং ইমাম বুখারীর কাছে দেখলাম।
 আরো মনে রাখা উচিত, যে সহীহ হাদীস মোতাবেক সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগ থেকে আমল হচ্ছে, যার উপর ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমেরউস্তাদের উস্তাদরা আমল করেছেন, ফিকহ ও হাদীসের ইমামগণ যার উপর মাসআলার ভিত্তি রেখেছেন তাকে শুধু এই ছুতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে নিয়েআমলের গন্ডি থেকে বের করে দেওয়া যে, হাদীসটি বুখারী-মুসলিমে কেন আসেনি-এ কি ন্যায় ও যুক্তির কথা হতে পারে? হাদীস-সুন্নাহর কোনোদলিল এমন করতে বলে কি না তা চিন্তা করা কি প্রয়োজন নয়?
সহীহর মোকাবেলায় হাসান কি গ্রহণযোগ্য নয়?
উপরের উদাহরণ থেকে পরিষ্কার হয়েছে যে, এক বিষয়ে যদি দুইটি মুখতালিফ হাদীস বিদ্যমান থাকে, যার একটি সহীহ, অন্যটি হাসান, তাহলেসহীহ সর্বাবস্থায় হাসানের চেয়ে অগ্রগণ্য হবে তা অপরিহার্য নয়। কেউ কেউ মনে করে, সহীহ-হাসানে তাআরুয (বিরোধ) মনে হলে সর্বাবস্থায়সহীহকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। ইনসাফের কথা এই যে, এখানেও ইখতিলাফুল হাদীসের মূলনীতি প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ দুই হাদীসের মধ্যেইখতিলাফ (বাহ্যত বিরোধ) মনে হলে বিরোধ নিষ্পত্তির যে মূলনীতি আছে, অর্থাৎ জমা (সমন্বয়) তারজীহ (অগ্রগণ্যতা বিচার) নাসখ(নাসিখ-মানসূখ নির্ণয়) সে অনুযায়ী নিষ্পত্তি করতে হবে। যদি তারজীহ বা অগ্রগণ্যতার প্রসঙ্গ আসে তাহলে যে হাদীস অগ্রগণ্য সাব্যস্ত হবে তারউপর আমল করা হবে।
অগ্রগণ্য হাদীস ঐ হাদীসকে বলে, যাতে এক বা একাধিক অগ্রগণ্যতার কারণ বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং সহীহর বিপরীতে হাসান হাদীসে যদি একবা একাধিক শক্তিশালী কারণ অগ্রগণ্যতার থাকে তাহলে তাকেই অগ্রগণ্য করতে হবে।
যারা বলেছেন, ‘আসাহ’ (অধিক সহীহ) সহীহর চেয়ে অগ্রগণ্য, সুতরাং এখানে সমন্বয় চেষ্টার প্রয়োজন নেই, তাদের মতকে হাফেয ইবনে হাজাররাহ. ‘‘ইনতিকাযুল ইতিরায’’ গ্রন্থে (খন্ড ১, পৃষ্ঠা : ৫৮) খন্ডন করেছেন।
তিনি লেখেন-
وأما دعوى أن الجمع لا يكون إلا في المتعارضين، وأن شرط المتعارضين أن يتساويا في القوة، فهو شرط لا مستند له، بل إذا صح الحديثان وكان ظاهرهما التعارض وأمكن الجمع فهو أولى من الترجيح.
অর্থাৎ এই দাবি করা যে, সমন্বয় শুধু দুই মুতাআরিযের (বাহ্যত বিরোধপূর্ণ) মাঝে হয়ে থাকে আর মুতাআরিয তখনই হয়, যখন দুটোই শক্তির দিকথেকে সমান হয়-এটি দলিলহীন শর্ত। বরং দুই হাদীস সহীহ হলে এদের মাঝে যদি বাহ্যত বিরোধ পরিলক্ষিত হয় এবং সমন্বয় সাধন সম্ভব হয়তাহলে সেটিই তারজীহের চেয়ে উত্তম।
হাফেয ইবনে হাজার রাহ. এ কথা বলেছেন মুসতাদরাকে হাকিম ও সহীহ বুখারীর দুটো হাদীসের উপর আলোচনা করতে গিয়ে, যে দুই হাদীসেরমাঝে বাহ্যত বিরোধ দেখা যাচ্ছিল। কেউ এখানে সহীহ বুখারীর হাদীস ‘আসাহ’ (অধিক সহীহ) হওয়ার যুক্তিতে মুসতাদরাকের হাদীস প্রত্যাখ্যানেরপ্রস্তাব করেছিলেন। এই প্রস্তাব ভুল সাব্যস্ত করে ইবনে হাজার উপরের কথা বলেন।
তদ্রূপ তিনি তার কিতাব ‘শরহু নুখবাতিল ফিকারে’র দরসে বলেছেন, সহীহ ও হাসানের মাঝেও তাআরুয (বিরোধ) দাঁড়াতে পারে। সুতরাং মানসূখ(রহিত) রেওয়ায়েত সহীহ পর্যায়ের আর নাসিখ (রহিতকারী) রেওয়ায়েত হাসান পর্যায়ের হওয়া খুবই সম্ভব।-আলইয়াওয়াকীতু ওয়াদ দুরার আলাশরহি নুখবাতিল ফিকার, আবদুর রউফ আলমুনাভী খন্ড ১, পৃষ্ঠা : ৩০৬; হাশিয়া কাসিম ইবনে কুতলুবুগা পৃষ্ঠা : ১০৯; হাশিয়াতুল কামাল ইবনেআবী শারীফ আলা শরহি নুখবাতিল ফিকার পৃষ্ঠা : ৭৩
যদি সহীহর বিপরীতে হাসানের কোনো গুরুত্বই না থাকে তাহলে তা সহীহর জন্য নাসিখ কীভাবে হয়?
সুন্নাহকে সনদভিত্তিক মৌখিক বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করা
শরীয়তের সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে বড় দলীল হল কুরআন কারীম। এরপর  সুন্নাহর স্থান। কিন্তু সুন্নাহের ব্যাপারে কতিপয় মানুষের এই ধারণা আছেযে, যেসব হাদীস সুস্পষ্টভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা বা কাজ হিসেবে সহীহ বর্ণনা-পরম্পরায় এসেছে শুধু তাই সুন্নাহ।এই ধারণা ঠিক নয়। সুন্নাহ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা ও নির্দেশনাবলির নাম। এই শিক্ষা ও নির্দেশনা আমাদের কাছেসাধারণত মৌখিক বর্ণনা সূত্রে পৌঁছে থাকে এবং সাধারণ পরিভাষায় এইসব মৌখিক বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত রেওয়ায়েতগুলোকেই ‘হাদীস’ বলে। কিন্তুঅনেক সময় এমন হয় যে, রাসূলে কারীম সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ কোনো শিক্ষা বা নির্দেশনা আমাদের কাছে মৌখিক বর্ণনারস্থলে কর্মের ধারাবাহিকতায় পৌঁছায়। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম নবীজী থেকে কর্মের মাধ্যমে তা গ্রহণ করেছেন; তাদের নিকট থেকে তাবেয়ীগণগ্রহণ করেছেন। এভাবে প্রত্যেক উত্তরসূরি তার পূর্বসূরি থেকে কর্মের মধ্য দিয়ে নবীজীর সেই শিক্ষাকে গ্রহণ করেন। নবী-শিক্ষার এই প্রকারটিকেপরিভাষায় ‘আমলে মুতাওয়ারাস’ বা ‘সুন্নতে মুতাওয়ারাসা’ বলে।
নবী-শিক্ষা ও নবী-নির্দেশনার অনেক বিষয় এই পথেই পরবর্তীদের হাতে পৌঁছেছে। এইসব শিক্ষা-নির্দেশনা যদি মৌখিক বর্ণনাসমূহের মধ্যেওতালাশ করা হয় তাহলে অনেক সময় এমন হয় যে, হয়ত এ ব্যাপারে কোনো মৌখিক বর্ণনা পাওয়া যায় না অথবা পাওয়া গেলেও সনদের দিকথেকে তা হয় যয়ীফ। এখানে এসে স্বল্প-জ্ঞান কিংবা স্বল্প-বুঝের লোকেরা বিভ্রান্ত হয়। তারা যখন বিশুদ্ধ মৌখিক বর্ণনাসূত্রে বিষয়টি খুঁজে পায় না তোনবীজীর এই শিক্ষাটিকেই অস্বীকার করে বসে। অথচ মৌখিক সাধারণ বর্ণনা-সূত্রের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী সূত্র তাওয়ারুস তথা ব্যাপক ওসম্মিলিত কর্মধারার মাধ্যমে বিষয়টি সংরক্ষিত।
তদ্রূপ নবী-শিক্ষার একটি অংশ হল যা আমাদের কাছে সাহাবায়ে কেরামের শিক্ষা-নির্দেশনার মধ্য দিয়ে সংরক্ষিত আছে। সাহাবায়ে কেরামেরঅনেক নির্দেশনা এমন আছে যার ভিত্তি শরীয়তসম্মত কিয়াস ও ইজতিহাদ। এগুলো শরীয়তের দলীল হিসেবে স্বীকৃত। আবার তাদের কিছু নির্দেশনাও কিছু ফাতওয়া এমন আছে যা তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো কথা বা কাজ থেকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অন্যকেশিখানোর সময় এর উদ্ধৃতি দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। কেননা প্রেক্ষাপট থেকে এ কথা স্পষ্ট ছিল যে, তাঁরা নবীজীর শিক্ষা ও নির্দেশনারভিত্তিতেই তা শিক্ষা দিচ্ছেন। এজন্য দ্বীনের ইমামগণের সর্বসম্মত নীতি হল, সাহাবায়ে কেরামের যে ফাতাওয়া বা নির্দেশনার ব্যাপারে এটা সুনির্দিষ্টযে, এটি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা-নির্দেশনা থেকেই গৃহীত, এতে সাহাবীর ইজতিহাদ বা কিয়াসের কোনো প্রভাব নেই তামারফূ হাদীসেরই অন্তর্ভুক্ত। কোনো মাসআলায় এর মাধ্যমে প্রমাণ দেওয়া মারফূ হাদীসের দ্বারা প্রমাণ দেওয়ার শামিল। পরিভাষায় একে মারফূহুক্মী বলে। নিঃসন্দেহে এর ভিত্তি কোনো মারফূ হাকীকী বা স্পষ্ট মারফূ। তবে এটা জরুরি নয় যে, হাদীসের কিতাবসমূহে সেই স্পষ্ট মারফূ হাদীসটিসহীহ সনদে বিদ্যমান থাকবে। এখানেও স্বল্প-বুঝের লোকেরা পদস্খলনের শিকার হয় এবং নবীজীর শিক্ষাটিকেই অস্বীকার করে বলতে থাকে যে,এর কোনো ভিত্তি পাওয়া গেল না, অথচ মারফূ হুকমীর সূত্রে প্রমাণিত হওয়াও দলীল হিসাবে যথেষ্ট।
উদাহরণস্বরূপ ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রাহ.-এর হাওয়ালা উল্লেখ করা যায়। তিনি তাকবীরে তাশরীকের উপর আলোচনা করে লেখেন, তাকবীরেতাশরীক মশরূ হওয়ার বিষয়ে আলিমগণ একমত। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সহীহ মরফূ হাদীস নেই। শুধু সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের পরবর্তীব্যক্তিদের থেকে কিছু আছর বর্ণিত হয়েছে এবং এর উপর মুসলমানদের আমল রয়েছে। এরপর লেখেন-
وهذا مما يدل على أن بعض ما أجمعت الأمة عليه لم ينقل إلينا فيه نص صريح عن النبي صلى الله عليه وسلم، بل يكتفي بالعمل به.
 অন্য কিছু হুকুমের সাথে এই হুকুমটিও প্রমাণ করে যে, যেসব বিষয়ে উম্মতের ইজমা হয়েছে তন্মধ্যে কিছু বিষয় এমনও আছে, যে সম্পর্কেআমাদের কাছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে স্পষ্ট কোনো নস বর্ণিত হয়ে আসেনি; বরং এ বিষয়ে শুধু আমলে (মুতাওয়ারাছ-এর)উপরই নির্ভর করতে হয়।-ফাতহুল বারী ফী শরহি সহীহিল বুখারী, ইবনে রজব হাম্বলী (৭৩৬হি.-৭৯৫হি.) খ. ৬, পৃ. ১২৪
সহীহ হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন সুন্নাতের পাশাপাশি খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে অনুসরণ করার এবং তাকেমজবুতভাবে অবলম্বন করার আদেশ করেছেন। ইরশাদ করেছেন-
انه من يعش منكم بعدي فسيرى اختلافا كثيرا، فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين، تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ ... وإياكم ومحدثات الأمور، فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة.
 ‘‘মনে রেখো! আমার পরে তোমাদের যারা জীবিত থাকবে তারা বহু মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন আমার সুন্নত ও আমার হেদায়াতপ্রাপ্তখলীফাগণের সুন্নতকে আকড়ে রাখবে। একে অবলম্বন করবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে রাখবে ... এবং তোমরা (ধর্মীয় বিষয়ের) নবআবিস্কৃতবিষয়াদি থেকে খুব সতর্কতার সাথে বেuঁচ থাকবে। কেননা প্রতিটি নবআবিস্কৃত বিষয় বেদআত। আর প্রতিটি বিদআত গোমরাহী।’’-সুনানে আবুদাউদ, হাদীস : ৪৬০৭; জামে তিরমিযী  ৫/৪৩, হাদীস : ২৬৭৬; মুসনাদে আহমদ ৪/১২৬, হাদীস : ১৬৬৯২; সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস : ৪২;সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৫
জামে তিরমিযীর ২২২৬ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পরে খেলাফতের মেয়াদ ত্রিশ বছর হওয়ার ভবিষ্যৎবাণীখোদ নবীজীই করে গেছেন। সে হিসেবে নবী-পরিভাষায় খুলাফায়ে রাশেদীন চারজন- ১. আবু বকর রা. ২. উমর রা. ৩. উসমান রা. ৪. আলী রা.। তাঁরশাহাদত ৪০ হিজরীর রমযানে হয়েছে।
যেহেতু খুলাফায়ে রাশেদীনের ব্যাপারে ওহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জেনেছিলেন যে, তাঁদের জারিকৃত সুন্নতসমূহনবী-শিক্ষার উপরই ভিত্তিশীল হবে, তাঁদের সুন্নতসমূহ নবী-সুন্নতেরই অনুগামী হবে এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি মোতাবেক হবে এজন্য রাসূলেকারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে ব্যাপক ঘোষণা দিয়ে বলে যান যে, তোমরা খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে মজবুতভাবে অাঁকড়েরাখবে।
সুতরাং যখন উম্মতের সামনে কোনো বিষয়ে প্রমাণ হবে যে, এটি চার খলীফার কোনো একজনের সুন্নত তখন তার অনুসরণের জন্য রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপরোক্ত আদেশই যথেষ্ট। আমাদের জন্য আরো অগ্রসর হয়ে এটা ভাবার প্রয়োজন নেই যে, তাঁদের এইসুন্নতের ভিত্তি কী ছিল এবং তাঁরা এই সুন্নত কোন নবী-শিক্ষা থেকে গ্রহণ করেছেন। এখানেও স্বল্প জ্ঞান ও স্বল্প বুঝের লোকদের অভ্যাস হল,খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতের ভিত্তি হাদীসের কিতাবসমূহে খুঁজতে থাকা। এরপর সহীহ সনদে নবীজীর স্পষ্ট কোনো বাণী যদি বিশেষ এই ব্যাপারেতারা না পায় তখন তাকে অস্বীকার করে বসে এবং অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে একে বিদআত আখ্যা দিয়ে দেয়। অথচ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিন্দিত ইখতিলাফ থেকে বাঁচার এই পথইদেখিয়েছেন যে, আমার সুন্নত ও আমার খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে মজবুতভাবে অবলম্বন কর। এরপর বলেছেন, বিদআত থেকে বেঁচে থাক।একটু চিন্তা করুন, যদি খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত বিদআতই হত তাহলে নবীজীর এই ইরশাদের কোনো অর্থ থাকে কী?
 সুন্নাহর পরে শরীয়তের তৃতীয় বুনিয়াদী দলিল হল ইজমা। এর বিভিন্ন ধরন এবং অনেক পর্যায় আছে। এর মধ্যে সর্বপ্রধান ও সর্বশ্রেষ্ঠ হলরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুহাজির-আনসার এবং অন্যান্য সাহাবীগণের ইজমা। এই ইজমা যদি ব্যাপকভাবে এবং অবিচ্ছিন্ন ওসম্মিলিতরূপে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছায় তবে তা শরীয়তের অনেক বড় অকাট্য দলিল। এ দলিল থাকা অবস্থায় অন্য কোনো দলিলের প্রয়োজন নেই।
আর ইজমাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করার জন্য এরও প্রয়োজন নেই যে, এই ইজমা কীসের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়েছে তার অনুসন্ধানে অবতীর্ণহওয়া। কেননা শরীয়ত নিজেই ইজমাকে দলিল সাব্যস্ত করেছে এবং যাঁদের মাধ্যমে ইজমা সম্পন্ন হয় তাঁদের ব্যাপারে আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেযে, এঁরা কখনো গোমরাহীর বিষয়ে একমত হতে পারে না। কুরআন মজীদে তো সুস্পষ্টভাবে মুহাজির ও আনসারী সাহাবীগণের অনুসরণের আদেশকরা হয়েছে এবং সাবীলুল মুমিনীন (মুমিনদের অনুসৃত পথ) থেকে বিমুখ হওয়াকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ বলা হয়েছে।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর মত, পথ ও রুচির সাথে একাত্মতা পোষণ করে না এমন ব্যক্তিদের অভ্যাস হল তারা কোনো মাসআলায় শুধুউম্মতের ফকীহবৃন্দ নয়, উম্মাহর শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ-সাহাবায়ে কেরাম, বিশেষত মুহাজির ও আনসারের ঐকমত্য থাকা অবস্থায় ভিন্ন দলিল তালাশকরতে থাকে। অথচ শরীয়ত এই ইজমাকে দলিল সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু ওইসব বন্ধু যদি শরীয়তের এই দলিলের সমর্থনে অন্য কোনো সহীহসনদওয়ালা স্পষ্ট হাদীস না পায় তাহলে এই মাসআলাটিকে অস্বীকার করে দেয়। কেউ তো আরো এক ধাপ বেড়ে অত্যন্ত দুঃসাহসিকতার সাথেশরীয়তের দলিল ইজমাকেই অস্বীকার করে বসে।
মনে রাখবেন, এসব হচ্ছে মূর্খতা ও শরীয়তের প্রতি অনাস্থা প্রকাশের সমার্থক। যদিও তা অসচেতনভাবেই হোক না কেন। অর্থাৎ শরীয়ত যেবিষয়টিকে দলিল সাব্যস্ত করেছে তারা তাকে মেনে নিতে পারছেন না।
এ বাস্তবতা সম্পর্কে যাঁদের চিন্তা ভাবনার সুযোগ হয় না তারা বিনা দ্বিধায় ঐ সকল সুন্নতকে ইনকার করে, যা তারা সনদ ভিত্তিক বা মৌখিক বর্ণনাসূত্রে সরাসরি قال رسول الله صلى الله عليه وسلم বা فعل رسول الله صلى الله عليه وسلم শব্দে কোনো সহীহ হাদীসে পান না। একারণে খুব সহজেই তারাখোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ এবং আমলে মুতাওয়ারাছকে ইনকার করেন। বিশ রাকাআত তারাবী, জুমার নামাযের প্রথম আযান, তারাবীতেকুরআন খতম, জুমার খোৎবা আরবীতে হওয়া, কালেমায়ে তাওহীদের উভয় অংশ একসাথে বলার বৈধতা لا إله إلا الله محمد رسول الله. ইত্যাদি অনেকবিষয়, যেগুলোর বড় দলীল বা প্রসিদ্ধ দলিল হচ্ছে খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত, মুসলিম উম্মাহর আমলে মুতাওয়ারাছ কিংবা আছারে সাহাবা ওতাবেয়ীন, এসব কিছুকে তারা এই বলে অস্বীকার করেন যে, এগুলো সহীহ হাদীসে নেই! তো উপরে উল্লেখিত বাস্তবতা সম্পর্কে চিন্তা করলে অনুমানকরতে পারবেন, তাদের নীতি কতটা ভুল ও মারাত্মক নীতি! অথচ খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ এবং আছারে সাহাবা ও তাবেয়ীন যে শুধু সুন্নতেনববীর সাথে যুক্ত তাই নয়, সনদ ভিত্তিক বর্ণনা সূত্রে বর্ণিত অনেক সহীহ হাদীসের (কওলী সুন্নতের) প্রকৃত অর্থ বোঝা ও তার প্রায়োগিক রূপউপলব্ধি করাও এর উপর নির্ভরশীল। আলোচনা দীর্ঘ হওয়ার আশংকা না হলে এখানে কিছু উদাহরণও উল্লেখ করা যেত। আহলে ইলম যদিমুহাদ্দিস হায়দার হাসান খান টুংকী রাহ.-এর রিসালা ‘‘আততাআমুল’’ও অধ্যয়ন করেন তাহলেও ইনশাআল্লাহুল আযীয চিন্তার পথ খুলে যাবে।এই রিসালা ‘আলইমাম ইবনু মাযাহ ওয়া কিতাবুহুস সুনানে’র হাশিয়ায় রয়েছে।
. ‘সহীহ’  ‘সুন্নতকে সমার্থক মনে করা
সহীহ বা হাসান পর্যায়ের প্রতিটি রেওয়ায়েত অবশ্যই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস। কারণ তা তাঁর থেকে প্রমাণিত। কেউকেউ মনে করেন, হাদীসে যা কিছু প্রমাণিত তা অবশ্যই সুন্নত বা মুস্তাহাব। অথচ সঠিক কথা হল, হাদীস দ্বারা যা প্রমাণিত তা শরীয়তের বিধান বটে, কিন্তু তা কোন প্রকারের এবং কোন পর্যায়ের বিধান; তা কিসুন্নত-মুস্তাহাব, না মোবাহ; সাধারণ বিধান না বিশেষ অবস্থার বিধান; সু্ন্নত হিসেবে করা হয়েছিল, না ওযরের কারণে বা শুধু বৈধতা বর্ণনার জন্যকরা হয়েছিল অথবা শুধু অভ্যাসগতভাবে*** করা হয়েছিল-ইত্যাদি অনেক সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম দিক আছে যেগুলোর গভীরে পৌঁছা ও সমাধান দেওয়ামুজতাহিদ ও ফকীহগণের কাজ। এজন্য আমাদের কর্তব্য, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদীস সব সময় মনে রাখা-
نضر الله امرء سمع منا حديثا فحفظه، حتى يبلغه غيره، فرب حامل فقه إلى من هو أفقه منه، ورب حامل فقه ليس بفقيه
অর্থাৎ আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে সজীব করুন, যে আমার নিকট থেকে কোনো হাদীস শুনেছে, অতপর তা মুখস্থ করেছে এবং অন্যের নিকট পৌঁছেদিয়েছে। কারণ ফিকহের অনেক বাহক তার চেয়ে অধিক ফকীহর নিকট তা পৌঁছে দিবে এবং ফিকহের অনেক বাহক নিজে ফকীহ নয়।-জামেতিরমিযী, হাদীস : ২৮৪৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৩৬৫২; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৬৭ ও ৬৮০
হাদীস বোঝার ক্ষেত্রে যারা শুধু অনুবাদের উপর নির্ভর করে, না হাদীস বোঝা ও হাদীস-ব্যাখ্যার প্রাথমিক ও স্বীকৃত নিয়মনীতি জানা আছে, নাজানার ইচ্ছা আছে আর না এ বিষয়ে আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও ফুকাহায়ে উম্মতের জ্ঞান-গবেষণার সহায়তা নেওয়াকে বৈধ মনে করে, এরা তোবুঝতেই পারবে না যে, হাদীস অনুসরণের নামে অজান্তেই তারা সুন্নাহ বিরোধিতায় লিপ্ত হবে।
এদের কেউ মনে করবে, সব লোক আহাম্মক, এরা মসজিদের বাইরে বা জুতার বাক্সে জুতা রাখে অথচ সুন্নত হল, জুতা পায়ে দিয়ে নামায পড়া! তবেমাথায় না টুপি থাকবে, না পাগড়ি। খালি মাথায় জুতা পায়ে নামায পড়া সুন্নত! 
কেউ মনে করবে, (নাউযুবিল্লাহ) পশ্চিমাদের রীতিই তো সঠিক। পেশাব তো দাঁড়িয়ে করাই সুন্নত!
কেউ বলবে, নামাযে নাতনিকে কাuঁধ তুলে নেওয়া সুন্নত!
কেউ ফরয নামাযের আগে পরের সুন্নতে রাতিবা (সুন্নতে মুয়াক্কাদা) এবং বিতরকে আম নফলের মতো মনে করে অবহেলা করবে, কিন্তু অতি উদ্যমপ্রদর্শন করবে মাগরিবের আগের দুই রাকাত নফলের বিষয়ে!
কেউ জুমআর আগের চার রাকাআত সুন্নতকে অস্বীকার করবে, জুমার পরের সুন্নত ত্যাগ করার বিষয়েও কোনো আফসোস হবে না, অথচ খোৎবাচলা অবস্থায় তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়তে ভুল করবে না।
কেউ মিসওয়াকের সুন্নত সম্পর্কে উদাসীন থাকবে, কিন্তু পাগড়ি বাঁধার বিষয়ে ভুল করবে না!
কেউ শোয়ার সময় চোখে সুরমা দিতে ভুলবে না, কিন্তু শোয়ার সময় দুআ ও যিকিরের কথা চিন্তাও করবে না!
কেউ তো দস্তরখান বিছানোর ক্ষেত্রে সামান্য শিথিলতাও করবে না, কিন্তু খাবারের কোনো দানা, তরকারির টুকরা পড়ে গেলে তা উঠিয়ে খাওয়ারধারে কাছেও যাবে না!
কেউ মৌলিক বিষয়াদিতে সালাফ ও আকাবিরের তরীকা থেকে সরে যাবে, কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত ও পরিবর্তনশীল বিষয়াদি অবস্থা ও চাহিদারপরিবর্তনের পরও আকাবিরের তরীকা আখ্যা দিয়ে তাতে জমে থাকবে আর এই ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করবে যে, আকাবিরের তরীকায় আছি!
কেউ নিজের সংশোধনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে সমাজের সংশোধনকে!
কেউ নিজের সন্তানের চিন্তার চেয়ে বেশি জরুরি বলবে উম্মতের চিন্তাকে!
কেউ দ্বীনের উপর আমল করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে দ্বীনের খেদমত ও দাওয়াতকে!
কেউ দ্বীনের বিধানের উপর আমল করার চেয়ে বেশি তৎপর থাকবে হুকুমতে ইসলামিয়া কায়েম করার ক্ষেত্রে।
মোটকথা, এই ধরনের এবং এর চেয়েও মারাত্মক ধরনের চিন্তাগত ও কর্মগত প্রান্তিকতার, যা আমাদের প্রায় সকল ঘরানায় কমবেশি বিস্তার লাভকরছে, এর কারণ এছাড়া আর কী যে, আমরা আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও ফুকাহায়ে উম্মতের জ্ঞান-গবেষণা থেকে কুরআন বোঝা, হাদীস বোঝাএবং হাদীস মোতাবেক আমল করার বিষয়ে হয়তো সহায়তা নেই না কিংবা সঠিক পন্থায় নেই না।
আমার এই অনুযোগ শুধু ঐ বন্ধুদের সম্পর্কেই নয়, যারা-আল্লাহ মাফ করুন-ফিকহের মাযহাব ও মুজতাহিদ ইমামদের সম্পর্কে বিদ্বেষ বাঅপ্রসন্নতা পোষণ করেন কিংবা তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও ভালোবাসা দিতে প্রস্ত্তত নন; আমার অনুযোগ ঐ ভাইদেরও প্রতি, যারা ফিকহের মাযহাবএবং আকাবির ও আসলাফের নাম নিয়েও الفقه العام للدين (দ্বীনের সাধারণ প্রজ্ঞা) এবং فقه الوسطية والاعتدال  (মধ্যপন্থা ও ভারসাম্য সম্পর্কে প্রজ্ঞা)অর্জনের বিষয়ে উদাসীন। এই ফিকহ ও প্রজ্ঞা তো আহলে ফিক্হ ও আহলে দিলের সোহবত ছাড়া এবং এ দুই বিষয়ে লিখিত প্রতি যুগের আহলেফিক্হ ও আহলে দিল ব্যক্তিদের নির্বাচিত কিতাবাদি পাঠ করা ছাড়া অর্জন করা সহজ নয়।
দলিলের শুধু সনদ দেখা। দলিল দ্বারা বিষয়টি কীভাবে প্রমাণ হয় এবং মূল আলোচ্য বিষয়ে তা প্রযোজ্য কি না- সম্পর্কে চিন্তা নাকরা।
কোনো হাদীস বা আছার দ্বারা কোনো বিধান প্রমাণ করতে হলে অনেকগুলো বিষয় দেখা জরুরি। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুটি :
১. ঐ হাদীস বা আছর নির্ভরযোগ্য কি না। তার সনদের মান এমন কি না, যা প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
২. বাস্তবিকই তা আলোচিত বিধানের উপর দালালত করে কি না (অর্থাৎ আলোচিত বিধানকে নির্দেশ করে কি না)। করলে সেটি কোন প্রকারের এবংকোন পর্যায়ের দালালত।
 কোনো হাদীস বা আছর দ্বারা মাসআলা প্রমাণ করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিষয়টির গুরুত্ব প্রথম বিষয় থেকে কোনো অবস্থাতেই কম নয়। উসূল ওমাবাদিয়াতের ইলম হাসিল করা ছাড়া শুধু অনুবাদের উপর নির্ভর করে যারা গবেষণার প্রাসাদ নির্মাণ করতে চান তারা দ্বিতীয় বিষয়ে থাকেন সম্পূর্ণউদাসীন।
যেমন কারো দাবি যদি এই হয় যে, ‘রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকুর তাকবীরের সময়, রুকু থেকে উঠে এবং দুই রাকাত থেকেউঠে সর্বদা রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন, কখনো এইসব জায়গায় রাফয়ে ইয়াদাইন ছাড়তেন না’ এরপর সহীহ বুখারীর এই হাদীস দ্বারা তা প্রমাণকরার চেষ্টা করেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. যখন নামায শুরু করতেন তখন আল্লাহু আকবার বলতেন এবং দুই হাত উঠাতেন, যখন রুকুকরতেন তখন দুই হাত ওঠাতেন, যখন سمع الله لمن حمده বলতেন তখন দুই হাত ওঠাতেন এবং যখন দুই রাকাতের পর দাঁড়াতেন তখন দুই হাতওঠাতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. এই আমল আল্লাহর রাসূল সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাওলায় বলতেন (মারফু হিসেবে বর্ণনাকরতেন)।-সহীহ বুখারী খ. ১ পৃ : ১৮০
নামাযের তিন জায়গায় সর্বদা রাফয়ে ইয়াদাইনের দাবি করে শুধু এই হাদীস দেখে যদি মনে করা হয় যে, তার পুরো দাবি প্রমাণ হয়ে গেছে তাহলেভুল হবে। কারণ এই হাদীসে তো শুধু এটুকু আছে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন। কিন্তু সব সময়করতেন তা তো এই হাদীসে বলা হয়নি। তেমনি একথাও বলা হয়নি যে, তিনি কখনো রাফয়ে ইয়াদাইন ছাড়া নামায পড়তেন না। উপরন্তু যখনঅন্য হাদীসে রাফয়ে ইয়াদাইন না করাও প্রমাণিত তখন তা অস্বীকার করার উপায় কী?
তেমনি কারো দাবি যদি এই হয় যে, রাফয়ে ইয়াদাইন সুন্নাতে মুআক্কাদা এবং রাফয়ে ইয়াদাইন না করা খেলাফে সুন্নত; এরপর দলিল হিসেবে ঐহাদীসটি পেশ করেন তাহলে যদিও তিনি সহীহ হাদীসই পেশ করেছেন, কিন্ত হাদীসটি তার দাবি প্রমাণ করে না। এই হাদীসে রাফয়ে ইয়াদাইন করাপ্রমাণিত হয়, কিন্তু তা মোবাহ, না বিভিন্ন সুন্নাহর একটি; সুন্নত হলে তা মুআক্কাদা, না মুস্তাহাব ও যীনাত-এসব বিষয়ে এই হাদীস নিশ্চুপ। এসবেরজন্য অন্যান্য দলীল ও করীনার প্রয়োজন, যা ফকীহগণের দৃষ্টিতে থাকে, কিন্তু অদূরদর্শী লোকেরা দাবি ও দলিলের মাঝে সামান্য মিল দেখলেই মনেকরে, আমাদের গোটা দাবি প্রমাণ হয়ে গেছে।
আরেকটি উদাহরণ : কেউ যদি দাবি করে যে, আযানের আগে আযানের মতো উঁচু আওয়াজে দরূদ পড়া সুন্নত; এরপর দলীল হিসেবে এইহাদীসটি পেশ করে-
من صلى علي واحدة، صلى الله عليه عشرا
যে আমার উপর একবার দরূদ পরে তার প্রতি আল্লাহ দশটি রহমত নাযিল করেন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪০৮
তাহলে হাদীস তো সহীহ, কিন্তু এর দ্বারা তার দাবি প্রমাণ হয়নি। কিন্তু তিনি যদি জিদ করেন যে, এ হাদীসে তো সময় নির্ধারণ করা নেই, আস্তেপড়ারও শর্ত নেই, সুতরাং জোরে পড়লেও এই ছওয়াব পাওয়া যাবে। কাজেই আমি আযানের আগে তা জোরে জোরে পড়ব। এরকম জোরাজুরিকরলে তাকে তো শুধু এটুকুই বলা যাবে যে, আপনি হাদীসের তরজমা পড়ার সাথে সাথে কিছুটা উসূলে ফিকহ এবং সুন্নত-বিদআত সংক্রান্তশরীয়তের মূলনীতি সম্পর্কেও পড়াশোনা করুন তাহলে বুঝতে পারবেন, আপনি সহীহ হাদীস তিলাওয়াত করেছেন বটে, কিন্তু তা আপনার দাবিরপক্ষে দলিল নয়। একে ঐ দাবির দলিল মনে করা ভুল।
আরেকটি উদাহরণ : কেউ যদি দাবি করেন যে, প্রত্যেক ফরয নামাযের পর ইমাম-মুকতাদী সবাই মিলে হাত তুলে জোরে জোরে দুআ করাদায়েমী সুন্নত; এরপর দলীল হিসেবে তিরমিযী শরীফের হাদীস পেশ করে যে, এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসাকরলেন,
أي الدعاء أسمع
কোন দুআ বেশি কবুল হয়? বললেন
جوف الليل ودبر الصلوات المكتوبة
মধ্য রাতের দুআ এবং ফরয নামাযের পরের দুআ। -জামে তিরমিযী, হাদীস : ৩৪৯৯
তাহলে এটা হবে দাবি প্রমাণের অসম্পূর্ণ প্রয়াস। কারণ হাদীস থেকে শুধু এটুকু প্রমাণ হয় যে, ফরয নামাযের পর দুআ কবুল হয়। এতে এই সময়দুআ করার উৎসাহ তো পাওয়া যায়, কিন্তু হাত তুলে সম্মিলিতভাবে জোরে জোরে দুআ করা এবং একে দায়েমী সুন্নত সাব্যস্ত করার বিষয়টি এইহাদীস দ্বারা প্রমাণ হয় না।
মোটকথা, এটি একটি দীর্ঘ প্রসঙ্গ। দাবি ও দলীলের মাঝে দূরত্বের এই ত্রুটি এবং তদজনিত বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকার জন্যই শুধু হাদীসের অনুবাদপড়ে দাবি-দলিলের ময়দানে নেমে পড়তে নিষেধ করা হয়।
আলিমের পরিবর্তে বিভিন্ন মাধ্যমকেই যথেষ্ট মনে করা।
ইলম শেখার স্বাভাবিক পদ্ধতি হচ্ছে আহলে ইলম, আহলে ফিক্হ ও আহলে দিল ব্যক্তিদের সাহচর্য অবলম্বন করা। হাদীস শরীফে আছে-
تعلموا، إنما العلم بالتعلم، والفقه بالتفقه، ومن يرد الله به خيرا يفقهه في الدين.
 তোমরা শেখো, ইলম তো শেখার দ্বারা আসে এবং ফিকহ আসে ফিকহের চর্চা ও শেখার দ্বারা। আর আল্লাহ যার সম্পর্কে কল্যাণের ইচ্ছা করেনতাকে দ্বীনের ফিকহ দান করেন।-ইবনে আবী আসিম, তবারানী-ফাতহুল বারী খ. ১ পৃ. ১৯৪
সাহবায়ে কেরাম ইলম ও ফিকহ অর্জন করেছেন সাহচর্যের দ্বারা। এরকম তাবেয়ীগণ সাহাবায়ে কেরামের সাহচর্যের দ্বারা, তাবে তাবেয়ীনতাবেয়ীনের সাহচর্য দ্বারা, এভাবেই এই ধারা চলে আসছে। যখনই আহলে ফিকহের সাহচর্য ত্যাগ করে শুধু কিছু উপায়-উপকরণকে ইলমহাসিলের পক্ষে যথেষ্ট মনে করা হয়েছে তখনই ইফরাত-তাফরীত (প্রান্তিকতা); বরং তাহরীফ-তাবদীলের (বিকৃতির) দরজা খুলেছে।
এ প্রসঙ্গে ড. নাসির আল-আকলের বক্তব্য ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। এর অনেক আগে ইমাম আবু ইসহাক শাতিবী রাহ. (৭০৯ হি.) তাঁর কিতাব‘আলমুয়াফাকাত’ খ. ১ পৃ. ৯১-৯২ (বারো নাম্বার মুকাদ্দিমায়) এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং দলিলসহ পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে,আদব, তাহকীক ও তাফাককুহ-এগুলো শুধু বই পড়ে হাসিল করা যায় না। এগুলোর জন্য সাহচর্য জরুরি।
গ্রন্থ পাঠ করে, আলোচনা শুনে কিংবা সিডি দেখে তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ করা যায়, কিন্তু ফাকাহাত ও বসীরত তথা প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি, ইতিদাল ওভারসাম্য, আদব ও নীতি এবং বিনয় ও তাওয়াজু হাসিল করতে হলে আহলে ফিকহ ও আহলে দিলের সোহবত জরুরি।
উসূলুল ফিকহকাওয়াইদুল ফিকহমাকাসিদুশ শরীয়াআসবাবুল ইখতিলাফআদাবুল ইখতিলাফ  আলফিকহুল আম লিদ্দীনসম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান  প্রজ্ঞা না থাকা।
এই সকল ইলম ও ফন অতি গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন-সুন্নাহর সঠিক ও মানসম্মত বুঝের জন্য এই শাস্ত্রগুলো অপরিহার্য। মনে করুন, একজন ব্যক্তিরকাছে এ সকল ইলমের কোনো সঞ্চয় নেই, তিনি তাফসীরে তাওযীহুল কুরআনের সাহায্যে কুরআন বোঝার চেষ্টা করছেন এবং সাধ্যমত উপদেশগ্রহণের চেষ্টা করছেন কিংবা মাআরিফুল হাদীস পাঠ করছেন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী হেদায়েত ও নির্দেশনা গ্রহণের  চেষ্টা করছেন তো এতে কোনোঅসুবিধা নেই, কোনো আপত্তিও নেই (তবে তাফসীরে তাওযীহুল কুরআনের তৃতীয় খন্ডের ভূমিকায় যে কথাগুলো আরজ করা হয়েছে সেগুলোরদিকে খেয়াল রাখা জরুরি)
আপত্তি তখনই হবে যদি তিনি তাওযীহুল কুরআনের লেখক হতে চান, মাআরিফুল হাদীসের লেখক হতে চান, কিংবা এই কিতাগুলোর উপরপর্যালোচনা বা এই কিতাবের লেখকদের উপর আপত্তি করতে চান অথচ উপরোক্ত ইলম ও ফনের কোনো সঞ্চয় তার নেই। নস বোঝা ও তারব্যাখ্যা-উপস্থাপনার প্রাথমিক বিষয়গুলোর সাথেও তার পরিচয় নেই, দ্বীন ইসলামের সাধারণ বুঝ ও প্রজ্ঞাও তার নেই, এরপরও তিনি তাহকীক ওগবেষণার ময়দানে প্রবেশ করেন এবং নির্দ্বিধায় নিজের মতামত প্রকাশ করতে থাকেন, এমনকি তা অন্যের উপর আরোপেরও চেষ্টা করতেথাকেন!!
এ পদ্ধতি কোথাও কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। উপরোক্ত ইলম ও ফনে পূর্ণ পারদর্শিতা বিপুল জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী আলিমদেরই হয়েথাকে। যাদের এসব বিষয়ে প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়েরও জানাশোনা আছে তারাও তো নিজের পরিধির বাইরে পা রাখা এবং আইম্মায়েমুজাতাহিদীন ও উলামায়ে উম্মতের বিরুদ্ধে মুখ খোলা থেকে বিরত থাকবেন।
স্বীকৃত বিষয়কে সাধারণ প্রচলনের মতো মনে করে বিরোধিতা  বিচ্ছিন্নতায় আগ্রহী হওয়া।
এক হচ্ছে الشائعات والمروجات যার অর্থ প্রচলিত। এতে দু ধরনের বিষয় আছে : এক. যা প্রচলিত এবং দলীল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দুই. যা প্রচলিত তবেভিত্তিহীন। আহলে ইলম, বিশেষত যাদেরকে আল্লাহ তাআলা তাজদীদী ও সংস্কারমূলক কাজের তাওফীক দিয়েছেন তারা ভিত্তিহীন বিষয়গুলোরসম্পর্কে সাবধান করেন। এগুলোই হচ্ছে বিদআতের খন্ডন এবং রসম-রেওয়াজের ইসলাহ সংক্রান্ত কিতাবাদির বিষয়বস্ত্ত। হাকীমুল উম্মতমাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর কিতাব اصلاح الرسوم-এর বাংলা তরজমা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রিসালা أغلاط العوام-এরও বাংলা তরজমাহয়েছে। তাজুদ্দীন ফাযারী রাহ. فقه العوام وانكار امور اشتهرت بين الأنام নামে কিতাব লিখেছেন।
ইলমে হাদীস, ইলমে তাফসীর সহ অন্যান্য ইলমের লেখকেরাও এই-দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ তো গেল প্রচলন সম্পর্কে কিছু কথা। আরেকটি বিষয় আছে, المسلمات والاجماعيات অর্থাৎ ঐসকল আকীদা, চিন্তা, মত, বিধান ও মাসআলা, যাইলমের ধারক-বাহকদের কাছে মুসাল্লাম ও স্বীকৃত এবং তার উপর সকল আহলে ইলম বা জুমহুর ও সংখ্যাগরিষ্ঠ আহলে ইলমের ইজমা রয়েছে।কোনো কোনো মানুষ তাদের জ্ঞানের স্বল্পতা ও আত্মগরিমার কারণে এইসব স্বীকৃত ও সর্বসম্মত বিষয়কেও সাধারণ প্রচলনের মতো মনে করে এবংএগুলোর দলিল খুঁজতে থাকে। বলাবাহুল্য, সীমিত অধ্যয়ন ও সীমাবদ্ধ দৃষ্টিতে প্রত্যেক বিষয়ের দলিল কীভাবে পাওয়া যাবে? তো নিজের অনুসন্ধানঅনুযায়ী যখন ঐসব স্বীকৃত কোনো বিষয়ের সুস্পষ্ট দলিল পায় না তখন তা পরিষ্কার ইনকার করে দেয়। তাদের জানা নেই যে, আহলে ইলমেরমাঝে সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত বিষয়াদির উপর আপত্তি করে ভিন্ন রাস্তা অবলম্বন করা হচ্ছে শুযূয। এটা ঐ শুযূযের অন্তর্ভুক্ত, যে সম্পর্কে হাদীসশরীফে এসেছে-
من شذ شذ في النار
যারা বলে অর্থ না বুঝে কুরআন তিলাওয়াতে কোনো ফায়েদা বা ছওয়াব নেই, অযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা জায়েয, বিনা ওজরে ত্যাগ করানামাযের কাযা নেই ... ইত্যাদি, তারা এই ভ্রান্তিরই শিকার। তারা স্বীকৃত বিষয়াদিকে সাধারণ প্রচলনের অন্তর্ভুক্ত করে নিজেরাও গোমরাহীর শিকারহয়, অন্যদেরও গোমরাহ করে।
যে বিষয়ে পারদর্শিতা নেই তাতে অনুপ্রবেশ করা।
ডাক্তার হোক, ইঞ্জিনিয়ার হোক, কিছু কিতাবের তরজমা পাঠ করে সহীহ-জয়ীফের ফতোয়া এবং কোন নামায হাদীসের মোতাবেক আর কোননামায হাদীসবিরোধী-এ জাতীয় কঠিন কঠিন ফতোয়া দিতে থাকা।
এ কাজ যেকোনো বিবেকবানের দৃষ্টিতেই অন্যায়, কিন্তু আজকাল এটারই সয়লাব চলছে। এখানে আমি শুধু শিরোনামটুকুই বললাম। মাসিকআলকাউসারের উদ্বোধনী সংখ্যায় প্রকাশিত ‘গবেষণা : অধিকার ও নীতিমালা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পাঠ করার জন্য অবশ্য অনুরোধ করব।
অন্যকে বিনা দলিলে অজ্ঞ মনে করা কিংবা সুন্নাহ বা সুন্নাহওয়ালার প্রতি অনুরাগী নয় মনে করা।
এটা সরাসরি কুধারণা, যা কুরআন হারাম করেছে। কারো সাথে মতভেদ হলে তার সম্পর্কে কুধারণা পোষণ করাও জায়েয-এই ধারণা ঠিক নয়।কারো সম্পর্কে না জেনে শুধু অনুমান করে কোনো কিছু বলা দুরস্ত নয়।
আসাবিয়ত  অন্যায় পক্ষপাত এবং তাকাববুর  অহংকার।
হাদীস শরীফে তাকাববুরের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে-
بطر الحق وغمط الناس
সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ মনে করা।
এই সংজ্ঞার আলোকে প্রত্যেকের কর্তব্য, নিজ নিজ অবস্থা বিচার করা। আসাবিয়ত ও অন্যায় পক্ষপাত শুধু ইমামের প্রতিই হয় না; নিজের চিন্তা ওপছন্দের প্রতিও হয়। আর এটাই বেশি খতরনাক।
১০মুহাসাবার অভাব
অন্য পক্ষের দলিল সম্পর্কে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে এই মুহাসাবা ও আত্মজিজ্ঞাসা জরুরি যে, ঐ পক্ষের কোনো গবেষক আলিম আমার সামনে থাকলেআমি কি এরূপ পর্যালোচনা করতে পারতাম।
আর প্রকৃত মুহাসাবা এই যে, আখিরাতের আদালতে আহকামুল হাকিমীনের সামনে (যদি আমাকে প্রশ্ন করা হয়) আমি কি আমার এই সিদ্ধান্তপ্রমাণ করতে পারব?
এভাবে মুহাসাবা করা হলে বিনা গবেষণায় বা অসম্পূর্ণ গবেষণার ভিত্তিতে পর্যালোচনা বা না-ইনসাফীর সাথে পর্যালোচনা বন্ধ হবে ইনশাআল্লাহ।আল্লাহ তাআলা আমাকে ও আমাদের সকলকে নিজের মুহাসাবা করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
 (চলবে ইনশাআল্লাহ) 
টীকা :
* তাকসীমে সাবয়ী অর্থ সাত প্রকারে বিভক্তকরণ। সম্ভবত মুহাদ্দিস ইবনুল সালাহ রাহ. (৬৪৬ হি.) সর্বপ্রথম এই ধারণা প্রকাশ করেন যে, সহীহহাদীস সাত প্রকার এবং প্রত্যেক উপরের প্রকার নীচের প্রকারের চেয়ে তুলনামূলক বেশি সহীহ। প্রকারগুলো এই-
১. যে হাদীস সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম দুই কিতাবেই আছে।
২. যা শুধু সহীহ বুখারীতে আছে।
৩. যা শুধু সহীহ মুসলিমে আছে।
৪. যা এই দুই কিতাবে নেই তবে এই দুই কিতাবের মানদন্ডে সহীহ।
৫. শুধু বুখারীর মানদন্ডে সহীহ।
৬. শুধু মুসলিমের মানদন্ডে সহীহ।
৭. যা না এই দুই কিতাবে আছে, না এই দুই কিতাবের মানদন্ডে  সহীহ। তবে অন্য কোনো ইমাম একে সহীহ বলেছেন।-মুকাদ্দিমাতু ইবনিস সালাহপৃ. ১৭০
হিজরী সপ্তম শতকে সহীহ হাদীসের এই প্রকারভেদ অজুদে আসার পর অনেক লেখক নিজ নিজ কিতাবে তা উদ্ধৃত করেছেন। তবে অনেকমুহাক্কিক মুহাদ্দিস বাস্তবতা বিচার করে বলেছেন, এই প্রকারভেদ উসূলে হাদীসের আলোকে সহীহ নয়। সহীহ হাদীসের শ্রেণী ও পর্যায় নির্ধারিতহবে ছিহহতের শর্ত ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে, বিশেষ কোনো কিতাবে থাকা বা না থাকার ভিত্তিতে নয়। যেমন অনেক হাদীস শুধু সহীহ বুখারীতে আছে,সহীহ মুসলিমে নেই, কিন্তু তার সনদ এমন যে, তা মুসলিমের মানদন্ডেও সহীহ। এ ধরনের হাদীসকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে নেওয়ার কী অর্থ? তেমনিকোনো হাদীস বুখারীতে নেই, শুধু মুসলিমে আছে, কিন্তু তার সনদ এমন যে, তা ইমাম বুখারীর নিকটেও সহীহ। এ হাদীসকে তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তকরা কি অর্থহীন নয়? তদ্রূপ যেসব হাদীস উভয় ইমামের মানদন্ডে সহীহ সেগুলো কি শুধু এই দুই কিতাবে সংকলিত না হওয়ার কারণে চতুর্থশ্রেণীতে চলে যাবে?
মোটকথা, এই প্রকারভেদকে শাস্ত্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। অনেক আহলে ইলমের মতো নিকট অতীতের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আহমদশাকির রাহ.ও (মৃত্যু : ১৩৭৭ হি.) এই তাকসীমের কঠোর সমালোচনা করেছেন। দেখুন : মুসনাদে আহমদে সহীফায়ে হাম্মাম ইবনে মুনাবিবহেরউপর তার ভূমিকা, খন্ড ৮ পৃষ্ঠা : ১৮২।

** ইমাম আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে মূসা আলহাযেমী রাহ. (৫৪৮ হি.-৫৮৪ হি.) ‘আলইতিবার ফিন নাসিখি ওয়াল মানসূখি মিনাল আছার’ কিতাবে(খন্ড : ১, পৃষ্ঠা ১৩২-১৬০) পঞ্চাশটি উজুহূত তারজীহ (অগ্রগণ্যতার কারণ) উল্লেখ করেছেন, যেগুলোর দ্বারা দুই মুখতালিফ (বাহ্যত পরস্পরবিরোধী) হাদীসের মধ্যে অগ্রগণ্য নির্ধারণে সহযোগিতা নেওয়া হয়।
এই পঞ্চাশ কারণের মধ্যে একটি কারণও এই বলেননি যে, দুই মুখতালিফ হাদীসের মধ্যে একটি বুখারী বা মুসলিমে আর অন্যটি অন্য কোনোহাদীসের কিতাবে থাকলে বুখারী-মুসলিমেরটি অগ্রগণ্য হবে!!
সাধারণত অগ্রগণ্যতা নির্ধারিত হয় অগ্রগণ্যতার কারণ ও বৈশিষ্ট্যের নিরিখে; কোনো বিশেষ কিতাবে থাকা বা না থাকার ভিত্তিতে নয়। মুজতাহিদইমামগণ কখনো কিতাবের ভিত্তিতে অগ্রগণ্যতার ফয়সালা করতেন না। হাদীস-সুন্নাহ এবং ফিকহে ইসলামী সংকলিত হওয়ার অনেক পরে এইনীতি সৃষ্টি হয়েছে যে, অমুক অমুক কিতাবকে হাদীস অনুসরণের ভিত্তি বানাও। অথচ এর দ্বারা অনেক সহীহ ও হাসান হাদীস বর্জিত হয়ে যায়।

*** নিঃসন্দেহে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি অভ্যাস জামাল ও কামালে পরিপূর্ণ। এসব বিষয়ে সাধ্যানুযায়ী তাঁর সাথেসামঞ্জস্য সৃষ্টি করা মহবতের দলীল এবং ছওয়াব ও বরকতের কারণ। কিন্তু মূল অনুসরণের ক্ষেত্র তো সুন্নতে হুদা। সুন্নতে হুদার বিষয়ে (যাতেআদাব অংশটিও শামিল) শিথিলতা করে নিছক অভ্যাসগত বিষয়াদিতে মুশাবাহাত-সামঞ্জস্য ইখতিয়ার করা এক ধরনের ধোকাও হতে পারে।উল্লেখ্য, দাড়ি লম্বা রাখা সুন্নতে হুদার গুরুত্বপূর্ণ বিধান এবং ওয়াজিব পর্যায়ের আমল।


পঞ্চম পরিচ্ছেদ
এই পরিচ্ছেদে বিক্ষিপ্ত কিছু বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা। তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।
১. রুচির পার্থক্য ও কর্মক্ষেত্রের বিভিন্নতা বিভেদ নয়
তিনটি বিষয় বৈচিত্র ও বিভিন্নতার বড় প্রশস্ত ক্ষেত্র : ১. নফল ২. মোবাহ ৩. দ্বীনের খিদমতের বিভিন্ন শাখা।
ফরয ইবাদত ও ফরয দায়িত্ব পালনের পর অবশিষ্ট সময় নফল কাজে ব্যয় করা উচিত। নফল কাজ অনেক। একেক জনের আগ্রহ একেক কাজের দিকে থাকে। কেউ নফল নামায বেশি পড়েন, কেউ নফল রোযা বেশি রাখেন। কারো আগ্রহ যিকিরের দিকে, কারো আগ্রহ ইলম বাড়ানোর দিকে। কেউ নফল হজ্ব, নফল ওমরা বেশি করেন, কেউ দান-সদকা বেশি করেন। তো যার যে কাজে আগ্রহ হয় করুন। এ হচ্ছে বৈচিত্র ও বিভিন্নতা। একে ঝগড়া-বিবাদ তো দূরের কথা, প্রশ্ন ও আপত্তির কারণও বানানো যায় না।
এটা ঠিক যে, পারিপার্শ্বিকতার বিচারে একেক জনের জন্য একেক রকম আমল বেশি উপযোগী হয়। এজন্য উত্তম হল, কোনো আলিমকে নিজের অবস্থা জানিয়ে পরামর্শ নেওয়া, নিজের শায়খের (দ্বীনী পরামর্শদাতার) কাছে জিজ্ঞাসা করা।
এখানে ইমাম মালিক রাহ.-এর একটি ঘটনা আমাদের মনে রাখা উচিৎ। ঐ যামানার বুযুর্গ আব্দুল্লাহ আলউমারী রাহ. ইমাম মালিক রাহ.কে লিখলেন, আপনি নির্জনতায় আসুন এবং ইনফিরাদী আমলে মশগুল হোন (ইমাম মালিক রাহ.-এর মূল ব্যস্ততা ছিল ফিকহ ও হাদীসের শিক্ষাদান)। ইমাম তাঁকে লিখলেন, আল্লাহ তাআলা যেমন রিযক বন্টন করেছেন তেমনি কর্মও বণ্টন করেছেন। কারো জন্য নফল নামায সহজ করেছেন, কিন্তু রোযা রাখা সহজ করেননি। আবার কারো জন্য সদকা আসান করেছেন, কিন্তু রোযা রাখা আসান করেননি। কারো জন্য জিহাদের আমলকে সহজ করেছেন।
ইলমের প্রচার প্রসারও একটি নেক আমল। আল্লাহ তাআলা এটি আমার জন্য সহজ করেছেন। এরই উপর আমি সন্তুষ্ট। আপনি যে কাজে আছেন (অর্থাৎ নির্জন সাধনা), আমার ধারণা আমার পছন্দের আমলটি তার চেয়ে অনুত্তম নয়। আশা করি, দুজনই আমরা কল্যাণ ও পুরস্কারের পথে আছি।-সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী ৭/৪২৪
একই কথা মোবাহ বিষয়াদির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একেক জনের একেক খাবার পছন্দ, একেক জনের একেক কাপড়; কারো গোল টুপি পছন্দ, কারো লম্বা টুপি; কারো এই জামা পছন্দ, কারো ঐ জামা। আল্লাহ তাআলা যে ক্ষেত্রকে মোবাহ রেখেছেন তাতে প্রত্যেকে নিজ নিজ রুচি ও স্বভাব অনুযায়ী যেকোনোটা অবলম্বন করতে পারে। এতে প্রশ্ন-আপত্তি ঠিক নয়। হ্যাঁ, কখনো পারিপার্শ্বিক কারণে একজনের জন্য একটি মোবাহ বিষয় বা পদ্ধতি উপযোগী হয়, তো অন্যজনের জন্য অন্যটি। এসব ক্ষেত্রেও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করা চাই। যার কোনো মুরবিব বা দায়িত্বশীল আছেন তার সাথেও অবশ্যই পরামর্শ করবে। তবে মনে রাখতে হবে, মোবাহ বিষয়ে নিজের রুচি, স্বভাব, পছন্দ বা নিজের শায়খ ও মুরবিবর রুচি ও পছন্দকে অন্য সবার উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যাবে না। কেউ এমন করলে তাকে হাদীসের ভাষায় বলা হবে-
      لقد لقد حجرت واسعا
  একটি প্রশস্ত ক্ষেত্রকে তুমি সংকুচিত করেছ।
আরো বলা হবে, মোবাহের অর্থই হচ্ছে এতে বাধ্যবাধকতা নেই। এরপরও কেন বাধ্যবাধকতা আরোপ করছেন?
ব্যবস্থাপনার বিষয়ও বৈচিত্রের এক বিস্তৃত ক্ষেত্র। ওখানেও অধিক উপযোগী নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য হতে পারে। একেও লোকেরা দ্বীনী ইখতিলাফ মনে করে। এটা ঠিক নয়। শরীয়ত ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে ঐক্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টি ও তা রক্ষার জন্য মশোয়ারা, আমীরের আনুগত্য ও সবরের উৎসাহ দিয়েছে। শান্তি চাইলে আমাদেরকে এই পথই অনুসরণ করতে হবে। নিন্দা-কটূক্তি জায়েযও নয়, এর কোনো সুফলও নেই।
দ্বীনী খিদমতের বিভিন্ন শাখা
দ্বীনের প্রচার প্রসারের জন্য, দ্বীনের হেফাযত ও সংরক্ষণের জন্য, দ্বীনের নুসরত ও খিদমতের জন্য এবং সমাজের সর্ব­স্তরে ও জীবনের সকল অঙ্গনে দ্বীনের আহকাম বাস্তবায়নের জন্য অনেক কাজের প্রয়োজন। প্রতিটি কাজ দ্বীনের নুসরতের এক-একটি ক্ষেত্র। দাওয়াত-ওয়াজ, তাবলীগ-তালীম, তারগীব-তারহীব, আমর বিল মারূফ-নাহী আনিল মুনকার, জিহাদ-তাযকিয়া, রাষ্ট্রের কর্ণধারদের অন্যায় ও গর্হিত কর্ম থেকে বিরত রাখার জন্য সাংগঠনিক তৎপরতা এবং এ ধরনের আরো যত বৈধ কাজ আছে সবগুলো দ্বীনের খিদমতের এক-একটি শাখা। প্রতিটি শাখার সাথে ছোট ছোট  অনেক প্রশাখা আছে। এখন দ্বীনের এই সকল বিভাগের কাজ একজন বা একশ্রেণীর  মানুষের পক্ষে সম্পন্ন করা কাম্যও নয়, সম্ভবও নয়। সুতরাং কর্মবণ্টনের নীতি অনুসরণ ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু আফসোস, কিছু মানুষ কর্মের বিভিন্নতাকেও ইখতিলাফ মনে করে এবং যে যেই শাখার সাথে যুক্ত তাকেই হক্ব এবং অন্য বিভাগকে অন্তত অপ্রয়োজনীয় মনে করে। অথচ প্রতি যুগের আকাবির কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফের জীবন ও কর্মের আলোকে এ কথাই বলে এসেছেন যে, রফীক বনো, ফরীক না বনো। অর্থাৎ সতীর্থ হও, প্রতিপক্ষ হয়ো না। দ্বীনের প্রত্যেক খাদিম, যে বিভাগেই সে নিয়োজিত থাকুক, দ্বীনের খিদমত করছে। কোনো নাজায়েয কাজে লিপ্ত না হলে এবং ভুল আকীদা, ভ্রান্ত চিন্তার প্রচার না করলে তিনি আমাদের মোবারকবাদ পাওয়ার উপযুক্ত। তিনিও তো আমাদেরই কাজ করছেন। তিনি আমাদের সঙ্গী ও সতীর্থ; শত্রু ও প্রতিপক্ষ নন। বন্ধুকে শত্রু মনে করা কত মারাত্মক ভুল!
হাদীসে আছে, একদিন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে এলেন। সেখানে দুটি হালকা ছিল : এক হালকায় দুআ ও তেলাওয়াত হচ্ছিল, অপর হালকায় তালীম ও তাআল্লুম (শেখা-শেখানো)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,উভয় হালকা নেক আমলে আছে। এরপর তিনি তালীম-তাআল্লুমের হালকায় বসলেন একথা বলে যে, আল্লাহ আমাকে শিক্ষক বানিয়ে পাঠিয়েছেন।-সুনানে ইবনে মাজাহ ১/৮৩; সুনানে দারিমী পৃ. ৫৪; আলফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ ১/১০-১১-আররাসূলুল মুআল্লিম ওয়া আসালীবুহু ফিত তালীম পৃ. ৯
যারা কর্মের বৈচিত্রকে বিধানের ইখতিলাফ সাব্যস্ত করেন কিংবা নিজের ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রের দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকান না তাদের জন্য-যদি তারা চিন্তা করেন-এই একটি হাদীসই যথেষ্ট।
কিছু লোক আছে, যারা এক মসজিদে একাধিক দ্বীনী কাজ পছন্দ করেন না কিংবা একই সময়ে মসজিদের দুই কোণে দুইটি হালকা, একে অপরের অসুবিধা করা ছাড়া, দুটি আলাদা কাজে মশগুল থাকাকেও সহ্য করতে পারেন না তাদের জন্যও এই হাদীসে চিন্তার উপকরণ আছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের বুঝ দান করুন এবং দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা-ন্যায় ও ভারসাম্য রক্ষার তাওফীক নসীব করুন। আমীন।
২. সকল ইখতিলাফকে নিন্দিত মনে করা এবং ইখতিলাফের দায় আলিমদের উপর চাপানো
সম্পূর্ণ প্রবন্ধটি মনোযোগের সাথে পড়া হয়ে থাকলে সম্ভবত পরিষ্কার হয়েছে যে, সকল ইখতিলাফ নিন্দিত নয়। একশ্রেণীর মানুষ সকল ইখতিলাফকে নিন্দিত মনে করে। অথচ তাদের নিজেদের মাঝেও আছে হাজারো ইখতিলাফ। এরপর কোথাও কোনো ইখতিলাফ দেখলে অতি সহজে এর দায়-দায়িত্ব আলিমদের উপর চাপিয়ে দেয় এবং আলিমদেরকে অভিযুক্ত করে।
কেউ কোনো বাতিল আকীদা প্রচার করল, কেউ শরীয়তের কোনো হুকুমের তাহরীফ করল, কেউ আল্লাহর বিধানের জায়গায় মাখলুকের আইনকে প্রধান্য দিল, কেউ জরুরিয়াতে দ্বীনের কোনো কিছুকে ইনকার করল এখন আহলে হক আলিমগণ যদি এর প্রতিবাদ করেন তাহলে এটাও ইখতিলাফ হয়ে যায় এবং এক্ষেত্রেও মতভেদের জন্য আলিমদেরকে অভিযুক্ত করা হয়!
এদের ভালো করে বোঝা উচিত, সকল ইখতিলাফ নিন্দিত নয়। যে ইখতিলাফ নিন্দিত তাতেও ইখতিলাফের দায় তার উপরই বর্তাবে, যে হক পথ ছেড়ে ভুল পথে গেল। তাওহীদ হক, শিরক বাতিল। সকলের কর্তব্য, তাওহীদের আকীদা গ্রহণ করে তাওহীদপন্থী হওয়া। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তাওহীদের দ্বীন ইসলাম থেকে বিমুখ হয়ে বিভিন্ন ধরনের শিরকে লিপ্ত, এমনকি কোনো কোনো কালিমা পাঠকারীও এই বিষয়ে অজ্ঞ এবং অজ্ঞতা বা হঠধর্মিতার কারণে শিরকে জলীতে লিপ্ত। তাহলে তাওহীদের ক্ষেত্রেও ইখতিলাফ হয়ে গেল, কিন্তু এই ইখতিলাফের জন্য দায়ী কে? যে তাওহীদের উপর আছে সে, না যে তাওহীদের বিরোধিতা করে শিরকে লিপ্ত হয়েছে সে?
সুতরাং মনে রাখতে হবে, ইখতিলাফের জন্য ঐ ব্যক্তিই দায়ী, যে হক্ব ত্যাগ করে বাতিল পথে যায় কিংবা শরীয়তসম্মত ইখতিলাফের ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি ত্যাগ করে ভুল পদ্ধতি অবলম্বন করে। যারা হক্বের উপর আছে, সঠিক নিয়মের উপর আছে তাদেরকে ইখতিলাফের জন্য অভিযুক্ত করা জায়েয নয়; বরং এমন করাটাই হচ্ছে নিন্দিত ইখতিলাফ।
এ বিষয়ে হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর রিসালা ইহকামুল ইতিলাফ ফী আহকামিল ইখতিলাফ পাঠ করা উচিত। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিলে এ
পুস্তিকার সারসংক্ষেপ সহজ ভাষায় আলকাউসারে প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে।
৩. আলিমদের মাঝে মতভেদ হলে আম মানুষ কী করবে?
এই প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে। আমল থেকে গা বাঁচানোর জন্য এবং ভুল থেকে ফিরে আসার সংকল্প না থাকলে অতি নিরীহভাবে এই অজুহাত দাঁড় করানো হয় যে, আমাদের কী করার আছে? আলিমদের মাঝে এত মতভেদ, আমরা কোন দিকে যাব? কার কথা ধরব, কার কথা ছাড়ব?
আমার আবেদন এই যে, আমরা যেন এই অজুহাত দ্বারা প্রতারিত না হই। এটি একটি নফসানী বাহানা এবং শয়তানের ওয়াসওয়াসা। নিচের কথাগুলো চিন্তা করলে এটা যে শয়তানের একটি ধোঁকামাত্র তা পরিষ্কার বুঝে আসবে।
১. জরুরিয়াতে দ্বীন, অর্থাৎ দ্বীনের ঐ সকল বুনিয়াদী আকীদা ও আহকাম এবং বিধান ও শিক্ষা, যা দ্বীনের অংশ হওয়া স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত, যেগুলো মুসলিম উম্মাহর মাঝে সকল যুগে সকল অঞ্চলে ব্যাপকভাবে অনুসৃত, যেমন আল্লাহর উপর ঈমান, তাওহীদে বিশ্বাস, আখিরাতের উপর ঈমান, কুরআনের উপর ঈমান, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর হাদীস ও সুন্নাহর উপর ঈমান, মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আখেরী নবী ও রাসূল হওয়ার উপর ঈমান; পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায, জুমার নামায, যাকাত, রোযা, হজ্ব ও পর্দা ফরয হওয়া, শিরক, কুফর, নিফাক, কাফির-মুশরিকদের প্রতীক ও নিদর্শন বর্জনীয় হওয়া, সুদ, ঘুষ, মদ, শূকর, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, মিথ্যাচার ইত্যাদি হারাম হওয়া এবং এ ধরনের অসংখ্য আকীদা ও বিধান, যা জরুরিয়াতে দ্বীনের মধ্যে শামিল তাতে আলিমদের মাঝে তো দূরের কথা, আম মুসলমানদের মাঝেও কোনো মতভেদ নেই। যারা দ্বীনের এই সকল স্বতঃসিদ্ধ বিষয়কেও বিশ্বাস ও কর্মে অনুসরণ করে না তারাও বলে; বরং অন্যদের চেয়ে বেশিই বলে যে, আলিমদের মাঝেই এত মতভেদ তো আমরা কী করব!
২. অসংখ্য আমল, আহকাম ও মাসাইল এমন আছে, যেগুলোতে আলিমদের মাঝে কোনো মতভেদ নেই। এগুলোকে ইজমায়ী আহকাম বা সর্বসম্মত বিধান হিসেবে গণ্য করা হয়। কিছু মানুষ এসব বিষয়েও নতুন মত ও পথ আবিষ্কার করে, এরপর আলিমদের অভিযুক্ত করে যে, তারা এখানে দ্বিমত করছেন!
৩. আল্লাহ তাআলা যাকে বিচার-বিবেচনার সামান্য শক্তিও দিয়েছেন তিনি যদি আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে সত্য অন্বেষণের নিয়তে জরুরিয়াতে দ্বীন (স্বতঃসিদ্ধ বিষয়াদি) এবং মুজমা আলাইহ (সর্বসম্মত বিষয়সমূহ) সামনে নিয়ে চিন্তা করেন তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারবেন যে, বাতিলের পক্ষাবলম্বনকারীরা আলিম (জ্ঞানী) নন; বরং হাদীসের ভাষায় عليم اللسان اللسان বাকপটু। এই শ্রেণীর লোকদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকলে আহলে হক্ব আলিমদেরকে, যারা আসসুন্নাহ ও আলজামাআর নীতি-আদর্শের উপর আছেন, চিনে নিতে দেরি হবে না। এরপর তাঁদের সাহচর্য অবলম্বন করলে তিনি তো নিন্দিত মতভেদ থেকে বেঁচেই গেলেন। আর বৈধ মতভেদপূর্ণ বিষয়াদিতে তিনি যদি তার দৃষ্টিতে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য আলিমদের নির্দেশনা অনুসরণ করেন তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। ইনশাআল্লাহ আখিরাতে তিনি দায়মুক্ত থাকবেন।
৪. কুরআন-হাদীসের বাণী ও ভাষ্য থেকে প্রাপ্ত কিছু চিহ্ন ও আলামত আছে, যেগুলোর সাহায্যে ঈমানদারির সাথে চিন্তা-ভাবনা করে কেউ কোনো আলিমকে নির্বাচন করতে পারেন, যার সাহচর্য তিনি গ্রহণ করবেন এবং যার সাথে দ্বীনী বিষয়ে পরামর্শ করবেন।
সময় করে আলিমদের মজলিসে যান, তাঁদের কাছে বসুন এবং লক্ষ করুন, যেসব আমল সর্বসম্মত, যে বিষয়গুলো সর্বসম্মতভাবে সুন্নত এমন বিষয়ের অনুসরণ আর যে বিষয়গুলো সর্বসম্মতভাবে নাজায়েয ও বিদআত তা বর্জনের বিষয়ে কে বেশি ইহতিমাম করেন, কার সাহচর্যের দ্বারা আখিরাতের ফিকির পয়দা হয়, ইবাদতের আগ্রহ বাড়ে, আল্লাহ তাআলার নাফরমানী সম্পর্কে অন্তরে ভয় ও ঘৃণা সৃষ্টি হয় এবং কার সঙ্গীদের অধিকাংশের অবস্থা এসব ক্ষেত্রে ভালো; কে পূর্ণ সতর্কতার সাথে গীবত থেকে বেঁচে থাকেন এবং প্রতিপক্ষের সাথেও ভালো ব্যবহারের আদেশ দেন; কার কথা থেকে বোঝা যায় কুরআন-হাদীসের ইলম তার বেশি, কার কথায় নূর ও নূরানিয়াত বেশি; তেমনি যে আলিমগণ সর্বসম্মতভাবে হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত তাঁরা কাকে সমর্থন করেন। এ ধরনের নিদর্শনগুলোর আলোকে বিচার করার পর কেউ যদি সালাতুল হাজত পড়েন, আল্লাহর দরবারে দুআ করেন, ইসতিখারা করেন, এরপর নেক নিয়তের সাথে কোনো আলিমকে নির্বাচন করেন তাহলে ইনশাআল্লাহু তিনি দায়মুক্ত হবেন।
তবে এক্ষেত্রেও জরুরি মনে করা যাবে না যে, সবাইকে ঐ আলিমের কাছেই মাসআলা জিজ্ঞাসা করা উচিত এবং তাঁরই কাছে পরামর্শ নেওয়া উচিত। তদ্রূপ মতভেদপূর্ণ বিষয়াদিতে ঐসব লোকদের সাথে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়া যাবে না, যারা অন্য আলিমের ফতোয়া ও নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করেন। অন্য কেউ যদি আল্লাহর রেযামন্দির জন্য চিন্তা-ভাবনা করে অন্য কোনো আলিমকে তার দ্বীনী রাহনুমা বানান তাহলে আপনার আপত্তি না থাকা উচিত, না তার সাথে আপনার তর্ক-বিতর্ক করা সমীচীন আর না আপনার সাথে তার।
যে আলিমদেরকে আপনি নির্বাচন করেননি তাদের সম্পর্কে কুধারণা পোষণ করা কিংবা তাঁদের সম্পর্কে কটূক্তি করা কোনোটাই জায়েয নয় এবং বিনা দলীলে তাদের কাউকে বাতিল মনে করাও বৈধ নয়। আপাতত এ কয়েকটি কথাই নিবেদন করলাম। আল্লাহ তাআলা যদি তাওফীক দান করেন আগামীতে এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
গত মজলিসে (সেমিনারে) ও পরে এমন কিছু প্রশ্ন এসেছে, যা সরাসরি প্রবন্ধের বিষয়বস্ত্তর সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রবন্ধটির বর্তমান সংস্করণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে দেওয়া মুনাসিব মনে হচ্ছে। অবশিষ্ট প্রশ্নগুলোর উত্তর আলকাউসারের প্রশ্নোত্তর বিভাগে লেখার চেষ্টা করা হবে ইনশাআল্লাহ।